বিতর্কের সম্মুখীন শোভন-রাব্বানীর কমিটি

বিতর্ক আর চাপা থাকলো না। রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে আলোচনা উঠলো গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায়ও।

এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ক্ষোভ থাকতে পারে, তবে কমিটি ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

গণভবনে শোভন-রাব্বানীর নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা-ক্ষোভ প্রকাশের খবর ছড়ানোর পর এ নিয়ে সংগঠনটি নেতাকর্মীরাই ফের মুখ খুলছেন। তারা বলছেন, সংগঠনের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে এ কমিটি ঘোষণা করায় সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকলেও হতাশ করেছে শোভন-রাব্বানীর কমিটি।

সংগঠনে সমন্বয়হীনতা, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া, মধুর ক্যান্টিনে সময় কম দেওয়া, দপ্তর সেল, পদবঞ্চিতদের মারধর করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিতর্কিত হয়েছেন তারা।

এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা বা মন্ত্রীরা উপস্থিত হয়ে গেলেও তাদের পরে উপস্থিতি অসন্তোষের মাত্রা বাড়িয়েছে আরও। ছাত্রলীগের দিকে সমালোচনার তীর এসেছে তাদের প্রচারমুখী কর্মকাণ্ডে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে। সম্মেলনের দুই মাস পর জুলাইয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দায়িত্বগ্রহণের ১০ মাস পর ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে।

কিন্তু এরপরই শুরু সংগঠনটিতে বিশৃঙ্খলা। বিতর্কিতদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে অভিযোগ তুলে মধুর ক্যান্টিনে বিক্ষোভ করে পদবঞ্চিতরা। সেখানে শোভন-রাব্বানীর অনুসারীরা হামলা করে বিক্ষোভকারীদের ওপর।

এরপর আন্দোলন-অনশন চালিয়ে যায় পদবঞ্চিতরা। এক পর্যায়ে কমিটিতে থাকা শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। পরে কমিটি থেকে বিতর্কিতদের প্রধানমন্ত্রী বাদ দিতে বললেও তাদের নাম ঘোষণা না করে পদশূন্য করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এতে বিতর্কিতরা বহালই আছে বলে অভিযোগ করা হয় পদবঞ্চিতদের তরফ থেকে।

বিতর্কিতদের পদে রাখা নিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর বিষয়ক উপ-সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ছাত্রলীগের দপ্তর সেল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক তথ্য থাকে। কিন্তু সেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর কর্মী শাহরিয়ার মমিন।

উপ-দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মুন্সী। এদের কারণে সংগঠনের তথ্য বাইরে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দপ্তর সেলের কার্যক্রম নিয়েও নেতাকর্মীদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিয়মিত প্রেস রিলিজে বানান ভুল চোখে পড়ছে সংবাদকর্মীদের।

এসব বিষয় নিয়ে সুমন বলেন, অধিকাংশই প্রেস রিলিজই রাত ১২টার পর দেওয়া হয়। কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। দপ্তর সম্পাদক তিন বছর ধরে চাকরি করেছে।

তার বিরুদ্ধে নেশা করার অভিযোগও রয়েছে। এরা দপ্তরটাকে বাসাকেন্দ্রিক করে ফেলেছে। এজন্য ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীরা তাদের কাজ যথাসময়ে করতে পারেন না। এসব কারণে সংগঠন বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ‍বিরুদ্ধে পোস্টার ছাপানোর ধরন নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। গত আগস্টে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে কুরআন খতম ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনের পোস্টারটিতে কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহার করা হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হয়। অনেকে সেজন্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে ‘ইসলামী ছাত্রলীগ’ বলে আখ্যায়িত করেন। এ ঘটনায় পরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কিছুই জানেন না বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

কমিটি গঠনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রলীগের নেতারা দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১১টি ইউনিটের মধ্যে দু’টো ইউনিটের কমিটি করতে পেরেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজে সম্মেলন হলেও কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি।

উপরন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে না পারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জন্য। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর এক অনুষ্ঠানেও তারা দেরি করে আসেন। মধুর ক্যান্টিনে কম সময় দেওয়ার পাশাপাশি সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সংগঠনের বর্ধিত সভা বিকেল ৪টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয় ৭টায়।

সবশেষ সিলেট থেকে প্লেনে ঢাকায় ফেরার পথে বিমানবন্দরে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে বিদায় জানাতে নিরাপত্তার সব জাল ছিঁড়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্লেনে উঠে পড়ার ঘটনা সমালোচনা বাড়িয়েছে কয়েক গুণ।

এ বিষয়ে ‘বিতর্কমুক্ত ছাত্রলীগ আন্দোলন’র মুখপাত্র রাকিব হোসেন বলেন, বর্তমান কমিটি প্রচারমুখী কাজে ব্যস্ত থেকেছে সবসময়। তারা মধুর ক্যান্টিনে নিয়মিত আসে না।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। সব তাদের বাসাকেন্দ্রিক। পুরো সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। কমিটি গঠনে আর্থিক লেনেদেনের অভিযোগও উঠেছে। জেলা কমিটিকে পাশ কাটিয়ে উপজেলা কমিটি দেওয়া হয়েছে। জেলা নেতাদের, সাংবাদিকদের ফোন রিসিভ করেন না তারা। যেখানে যান, সেখানে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ঘোরেন।

সংগঠনের এমন অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান রনি বলেন, ছাত্রলীগের কমিটি কখনো এক বছরের বেশি মেয়াদ থাকাটা জরুরি নয়।

তাছাড়া অমানবিক মনোভাবাপন্ন ও উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি থেকে সংগঠনমুক্ত রাখা দরকার। ঢাবিতে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে আগুন দেওয়া, পদবঞ্চিতদের নির্যাতন করে বিতর্কিতদের পুনর্বাসন, সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতিকে মারধর, এফ আর হলের সাধারণ সম্পাদকের রুম ভাঙচুরের মতো খুবই দুঃখজনক ঘটনা এই কমিটির সময়ে ঘটেছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে ফোন দেওয়া হলেও কল রিসিভ হয়নি। সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবিবের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর বিষয়ক উপ-সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, সাধারণ সম্পাদক (গোলাম রাব্বানী) শুধু নানার গল্প বলেন, দাদার গল্প বলেন না। তার দাদা যে বিএনপি করতেন! আর দায়সারাভাবে আগস্টের আলোচনাসভা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুক নিয়ে আলোচনাসভা সময় নিয়ে হওয়া উচিত। আমরা মনে করি সংগঠন পরিচালনায় তারা অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর