হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তী সময়ে যারা নাট্য জগতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন, সেইসব পরিচালকের সংখ্যা নেহায়ৎ কম নয়। তার মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও এমন অনেক পরিচালকের আগমন ঘটেছে যাদের নামে নাটক দর্শক দেখতেন। বিটিভি ও হুমায়ূন পরবর্তী সময়ে মূলত যাদের পরিচিতি মেলে।
ইউটিউবে সেদিন অনিমেষ আইচের পরিচালনায় ‘কাঁটা’ নাটকটি চোখে পড়লো। নাটকটি এর আগেও দেখা হয়েছে। সেদিন আবার দেখা হলো। এই নাটকটি আরেকটু ঘাষামাজা করলে নিশ্চিত একটা পুরস্কারপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা হতে পারতো। অনিমেষ আইচের এমন বহু কাজ আছে যা তাকে প্রথম সারির নাট্য নির্মাতা বানিয়েছে।
নুরুল আলম আতিক তো প্রায় হারিয়েই গেলেন। টেলিভিশন নাটকের প্রশংসিত নির্মাতা তিনি। এখন তাকে না পাওয়া যায় নাটকে, না সিনেমায়। দুটি সিনেমার কাজ তার হাতে রয়েছে। ‘মোরগের ঝুটি’ ও ‘মানুষের বাগান’ সিনেমা দুটির ভবিষ্যৎ কিছু বলা যায় না। তাকে নিয়ে মিডিয়ায় এখন তেমন আলোচনা নেই। গিয়াসউদ্দীন সেলিম নাটকের তুখোড় নির্মাতা। ‘মনপুড়া’ সিনেমায় তিনি সেই ধারা অব্যাহত রাখলেন। এরপর ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমাটি অবশ্য তেমন ব্যাবসা করতে পারেনি। তিনি মাঝেমধ্যে নাটক বানান। বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ততা একটু বেশি। কিন্তু এই পরিচালক এখন আর নাটকে নেই। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও এক সময় জনপ্রিয় নাটক বানাতেন। কিন্তু তিনি সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে ব্যস্ত হয়ে নাটক ছেড়ে দিলেন। অমিতাভ রেজা বরাবরই বিজ্ঞাপনের মানুষ। তবে মাঝেমধ্যে প্রশংসনীয় নাটকও নির্মাণ করেছেন। সালাউদ্দীন লাভলু এখন নির্মাণের চেয়ে অভিনয়ে বেশি মনোযোগ হয়েছেন। একটা সময় যে বৃন্দাবন-সালাউদ্দীন লাভলুর জুটি ছিল। সমসাময়িক সময়ে রোমান্টিক নাটকে ছিলেন শিহাব শাহিন, কৌশিক শংকর দাস, চয়নিকা চৌধুরীরা।
এই মানুষগুলো মিলে টেলিভিশন নাটককে যে অবস্থানে নিয়েছিলেন তা এখন নেই। উল্লেখিত নির্মাতারাও যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের পরবর্তী সময়ে রেদওয়ান রনি, ইফতেখার আহমেদ ফাহমিরাও নির্মাণ করেছেন জনপ্রিয় নাটক। কিন্তু কারো এখন আর খোঁজ মেলে না। কি থেকে কি নির্মাণ করেন সেই হিসেব শুধু তারাই জানেন।
একটা উদাহরণ টানা যায়, সেটা পাশের দেশের কথাই বলি। পাশের দেশের জাহাজওয়ালাদের খবর। নাটক নামক জাহাজটিকে তারা বেশ নিরাপদে চালাতে জানেন। যেখানে সেখানে তারা থামায় না। নির্ধারিত কিছু স্টেশনে থামায়। ফলে খুব দ্রুত এবং স্বাচ্ছন্দে গন্তব্যে পৌছে যাবে ভেবে যাত্রী এইসব জাহাজে উঠে পড়ে। দর্শকের বিশ্বাস এই পরিচালকরা গল্প নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের নামে একসিডেন্টও করবেন না। ফলে দেশী জাহাজে যাত্রী কম হচ্ছে বলে অনেকের ধারনা। অন্য একটি গ্রুপ এই ধারনা মানতে নারাজ। তাদের কথা আমাদের অধিকাংশ জাহাজের ভেতর আধুনিক সুযোগ সুবিধা নাই বলে যাত্রী সহজে আকর্ষন বোধ করে না। সেক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদরা কারিগরি দিক থেকে কতটা উন্নত ছিলেন সেটা এখন প্রশ্নের বিষয়। পরিচালককে বলা হয় ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ।
অর্থাৎ তিনিই জাহাজের নাবিক। তিনি যেভাবে জাহাজ চালাবেন সেভাবেই জাহাজ চলবে। নাটক, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে গিয়ে এই কথাটা প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। একজন ক্যাপ্টেন জাহাজ চালান। ঝড়, ঝঞ্চা, নদী সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ, দৈত্যরূপী স্রোতকে উপেক্ষা করে তিনিই জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যান নির্ধারিত গন্তব্যে। যিনি জাহাজ চালনায় যত বেশি দক্ষ, তার জাহাজে যাত্রীও থাকে বেশি। নাটক, সিনেমার ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। যে পরিচালক ভালো নাটক বানান তার নাটক দেখার জন্য দর্শক মুখিয়ে থাকে। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের দেশে টিভি নাটক ও সিনেমার এমন করুণ অবস্থা কেন? আমাদের দেশে শুধুমাত্র টিভি নাটক বানায় এমন পরিচালকের সংখ্যা চারশতাধিক। অর্থাৎ আমাদের আছে ৪শ ক্যাপ্টেন। এই ক্যাপ্টেনরা তাহলে কতটা অদক্ষ? এমন প্রশ্ন দর্শক করতেই পারেন। কেন যাত্রী উঠছে ভিনদেশি জাহাজে। নিজের দেশের জাহাজে উঠতে অনেকেই নারাজ। তাদের পছন্দ ভিনদেশি জাহাজ। তার মানে আমরা কি জাহাজ চালাতে অক্ষম? তাই বা বলি কি করে? ক্যাপ্টেনরা সবাই কি অক্ষম? নাকি অক্ষমতার ব্যপকতার মাঝে হারিয়ে । সবাই কি অক্ষম? নাকি আমাদের জাহাজ আধুনিক মানসম্পন্ন নয়? সেটাইবা বলি কি করে। আধুনিক ধ্যান ধারনার অনেক নির্মাতা আছেন আমাদের দেশে। তবুও আমাদের জাহাজে যাত্রী উঠতে চায় না কেন? এ ব্যাপারে কয়েকজন দর্শক প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করলেন। তারা বললেন, বর্তমান যুগ হলো গতির যুগ। আমরা দ্রুত গন্তব্যে পৌছাতে চাই। ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে এমনকি বিমানে উঠেই কখন গন্তব্যে পৌছাব এই চিন্তায় ছটফট করতে থাকি। সে কারনে যে যত কম সময়ে বিনোদন দিয়ে গন্তব্যে পৌছে দিতে পারবেন তার প্রতিই আকৃষ্ট হই। নাটক, সিনেমার ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। এখন আমাদের হাতে বিনোদনের অনেক মাধ্যম। তাই নির্দিষ্ট ধারায় দর্শক আর বন্দি থাকতে চায় না।