অগ্নি দুর্ঘটনায় পৃথিবীর শীর্ষে ঢাকা

শুধু দেশেই নয়, এবার সারা পৃথিবীতে অগ্নি দুর্ঘটনায় শীর্ষে আছে ঢাকা। যান্ত্রিক এই শহরের আনাচে-কানেচে প্রতিটি অংশই যেন মৃত্যুপুরি হিসেবেই পরিচিত সবার কাছে। কোন অংশেই যেন ঝুঁকির বাইরে নয়। ইট-সিমেন্টের গড়া রাজধানীর প্রতিটি ভবন হয়ে উঠতে পারে প্রাণহানির কারণ।

২০১৮ সালে সারাদেশে ৮ হাজার ৪৬১ টি আবাসিক ভবনে আগুন লাগে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৮টি দুর্ঘটনাই ছিল ঢাকায়। শিল্প কারখানায় ১ হাজার ১৩১টি অগ্নিকাণ্ডের ৫২৬টিই ঢাকায়।

পরিবেশ সংরক্ষণে আইনী সহায়তার সঙ্গে লড়ে যাওয়া ‘বেলা’র এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত এক দশকে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডে সারাদেশে মৃতের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১৫৯ জন। অথচ ২০১৮তেই ঢাকায় মৃতের সংখ্যা ১২১ জন। এ বছর ইতোমধ্যে প্রায় প্রায় শত প্রাণ আগুনের বলি হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভবনের অনুমোদিত নকশার দাগ পাল্টায় মালিকের ইচ্ছায়, সাথে ব্যবহারবিধিও। মালিকের সঙ্গে এখানেও রয়েছে উপর মহলের তদারকি। তাছাড়া অনুমতির বাইরে গড়ে উঠা বহুতল ভবনগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন আর সেগুলোর প্রতি কোন তদন্ত করাও হয় না বলে অভিযোগ আছে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি ব্রি.জে.আবু নাঈম শহীদুল্লাহ বলেন, নকশা পাস করে নিয়ে গেল, তারপর ভবন নির্মাণ করতে ৭-১০ বছর টাইম লাগে। তখন এই পক্ষের দিকে তারা আর ফিরে তাকাবে না। অকোফেশনাল সার্টিফিকেটটা খুব বেশি প্রয়োজন, এবং পরবর্তীতে এটা দেখা হবে যে আমি যেটা বলেছি, সেটা করেছি।

যান্ত্রিক এই রাজধানীতে গড়ে উঠা বহুতল ভবনগুলোর অধিকাংশই অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ক্ষমতার বাহিরে। এমনকি প্রাথমিক প্রতিরোধ করারও নিজস্ব কোনো সক্ষমতা নেই। নেই ধোঁয়া এড়িয়ে বেরিয়ে আসার মতো প্রশস্ত সিড়ি বা পানির ব্যবস্থাপনা রাখার জায়গা। তবে এ বিষয়টিও সরকারের তদন্তের বাইরে। ফলে গত দশ বছরে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়লেও ভবনের সংখ্যার অনুপাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী বলেন, একটা সেফ এক্সিট রুট লাগবে, আগুন লাগলে মানুষ যাতে নেমে আসতে পারে। এবং এখানে কোন ধোঁয়া, বা আগুন কিছুই থাকবে না। আরেকটা হচ্ছে, ফায়ার লিফট থাকতে হবে, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের লোকরা যেনো সেই লিফটটা আগুন নিভানোর কাজে ব্যবহার করতে পারে। সব ভবনের জন্য এই দুইটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যে কোন ভবনের ক্ষেত্রে নতুন করে মোডিফাই করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, শহরের সব ভবন দ্রুত যাচাই করে নকশা অনুযায়ী যথাযথ ফায়ার এক্সিট এবং প্রয়োজনীয় পানি ও অগ্নি নিরোধের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে বাধ্য করতে হবে মালিকদের। নতুবা, চিহ্ণিত করতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের ৪২৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৪১৬টিই ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে আছে৷ ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, মার্কেট, আবাসিক হোটেলসহ তিন হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকার মাত্র ৫টি মার্কেট ও শপিং মলের আগুন ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক।

২০১২ সালে ফায়ার সার্ভিস, ডেসা, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন দেয়া ১১২টি ভবনে বুয়েটের করা গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র দুটি ভবন তাদের সব নির্মাণ নীতিমালা মেনেছেন। বাকিরা কোনো না কোনো নিয়ম এড়িয়েছেন, অথবা মানলেও তা অকার্যকর।

২০১৬ সালে ড্যাপ-এর করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে সাততলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০ট। স্বাভাবিক নগরায়ন ও উন্নয়নের কারণে গত দুই বছরে এর সংখ্যা আরো ১০-১৫ ভাগ বেড়েছে৷ আইন অনুযায়ী এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে। তাহলে এটা স্পষ্ট যে দুই তৃতীয়াংশের বেশি বহুতল ভবনের ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেই। আর ৮০ ভাগ ভবনই কোনো না কোনোভাবে নিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন করে নির্মাণ করা হয়েছে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর