মুঘল আমলের উৎকর্ষতার জানান দিচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ

ইসলাম ধর্মের অনন্য নিদর্শন মুঘল আমলের অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’। ১৬৬২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরিফাইল গ্রামে নান্দনিক শৈলীতে নির্মিত হয় মসজিদটি। প্রাচীন স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর মসজিদটি দেখতে অনেকটা তাজমহলের মতো। ছাদের উপরে থাকা গম্বুজ এবং এর নান্দনিক কারুকার্য যেন জানান দিচ্ছে মুঘল আমলের উৎকর্ষতার। সুপ্রাচীন হওয়ায় বাংলাদেশের অনন্য এ স্থাপত্যটি প্রত্নিতাত্বিক বিভাগের তালিকাভুক্তও হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদটি প্রত্নতাত্বিক অধিদফতরের অধীন হলেও এর রক্ষনা-বেক্ষণে তাদের কোন তৎপরতা দেখা যায়না। স্থানীয়দেরকেই এর দেখভাল করতে হয়। সে সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় মসজিদ দেখতে আসা দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে দরবেশ শাহ আরিফ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং তার নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়।

সরেজমিন সরাইল উপজেলা সদরের আরিফাইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩৬১ বছল আগে নির্মিত আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ। উপজেলা সদর থেকে আধা কিলোমিটার দূরবর্তী আরিফাইল গ্রামের সাগরদিঘীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত মসজিদটির আয়তন লম্বার ৮০ ফুট ও প্রস্থে ৩০
ফুট। মসজিদের চার কোনায় চারটি বুরুজ ও মোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোর নিচে মসজিদের ভেতরে তিনটি রয়েছে যা ভিতরের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করেছে। গম্বুজগুলোতে পদ্মফুল অঙ্কিত রয়েছে। মসজিদটির ছাদ তিনটি বড় গম্বুজ দ্বারা আবৃত। চুন, সুরকি আর ইটের গাঁথুনীর সাথে মসজিদের ভেতরে ও বাহিরের অপরুপ কারুকার্য এর সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মূল গেইট থেকে কারুকার্য শুরু করে মসজিদের ভিতরেও বিভিন্ন অংশ কারুকার্য যেন জানান দিচ্ছে মুঘল আমলের উৎকর্ষতার। মসজিদটির মোট প্রবেশপথ ৫ টি, যার তিনটি হল পূর্বদিকে এবং বাকিদুটি যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বদিকে। মসজিদটির উত্তর পাশেই বিশাল আয়তনের একটি দীঘি। যার একটির নাম সাগর দীঘি। জনশ্রুতি রয়েছে সাগর দিঘী থেকে পানি পান করে আগত ব্যক্তিরা রোগমুক্ত হতেন। এছাড়াও মসজিদটির দক্ষিণে রয়েছে দুটি কবর, যা ‘জোড়া কবর’ বা ‘রহস্যময় কবর’ নামে পরিচিত। কবর দু’টিতেও মুঘল স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর প্রভাব বিদ্যমান। মসজিদের পাশে অবস্থিত জোড়া কবর নিয়ে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি ও কল্পকাহিনী। তবে সে সময় এগুলো কার মাজার ছিল তার প্রকৃত তথ্য এখনো অনাবিষ্কৃত। প্রতিদিন এই মাজারে লোকজন এসে নামাজ আদায় করে বিভিন্ন মান্নত করে।

স্থানীয়রা বলেন, মসজিদের ভিতরে কারুকাজ খুবই নান্দনিক। ভিতরের বিভিন্ন অংশে কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরাতন হলেও দূর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। প্রত্নতত্নর অধীনেও তারা কোন দেখভাল করে না। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে। তবে আগের অবকাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে। তারা আরো বলেন, এখানে একটি সাগর দিঘি রয়েছে যার পানি পান করলে মানুষ এক সময় রোগমুক্ত হতো বলে আলোচনা রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ শের আলম বলেন, শত শত বছর ধরে মসজিদটি টিকে আছে ইতিহাসের নির্দশন হিসেবে। ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসে। তবে এখানে আসার সড়ক যোগযোগ ব্যবস্থা সরু হওয়ায় দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ রাস্তাটি প্রশস্ত করলে দর্শনার্থীদের চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল লতিফ খন্দকার বলেন, এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছে বলে আমরা বাব-দাদা কাছ থেকে শুনতে পেরেছি। অনেকেই আবার গায়েবী মসজিদ বলেও ডাকে। এর উত্তর পাশে একটি বড় দিঘী রয়েছে যা সাগর দিঘী নামে সবাই ডাকে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলোকে সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসগুলো সংরক্ষিত হতো।

আরাফাইল মসজিদের খতিব নজরুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদের আযান ও ইমামমতি করে আসছি। প্রতিদিনই এটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখছি। দেশের বিভিন্ন পর্যটক আসে ও টাকা পয়সা দান করে। এলাকাকাসী ও তাদের টাকায় মসজিদ চলে।

আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন মন্তু বলেন, আগ্রার তাজমহলের সাথে অনেকটাই মিল আছে। ইট, সুরকির গাঁথুনি দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মসজিদটি। এটি প্রত্নতত্ব বিভাগের অধীন হলেও তারা কেবল সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর উন্নয়নে তারা তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। এর রক্ষণাবেক্ষণ আমরা স্থানীয় লোকজন দেখবাল করে আসছি। আমরা আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে ৩ শতাধিক বছরের সুপ্রাচীন এই মসজিদ পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে উপস্থাপিত হবে।

সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন বলেন, সরাইল একটি ঐতিহ্যবাহি জনপদ। প্রায় ৩ শতাধিক বছরের পুরানো আরিফাইল মসজিদ।
এটি দেখার জন্য অনেক পর্যটক আসে। এটির অন্যন্য উন্নয়ন কর্মকান্ড যাতে করা যায় সে উদ্যোগটি নেয়া হবে। সড়কটি যেহেতু সংকীর্ণ কিভাবে প্রশস্ত করা যায় সে বিষয় আমরা দেখব।

যেভাবে যাওয়া যায়:

বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল বিশ্বরোড মোড় নেমে সিএনজি অটোরিকশা যোগে ২০ মিনিট গেলেই সরাসরি মসজিদে যাওয়া যায়। সরাইল উপজেলা চত্বরের মূল ফটক থেকে রিক্সা যোগে কিংবা পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর