মিলেমিশে অনিয়মকে নিয়ম বানান কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব

চেয়ারম্যান বনাম সচিব দুইজনই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর তারা যখন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তখন পুরো প্রতিষ্ঠানটিতেই ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙ্গে পড়ে। এমনই অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

অপরদিকে সম্প্রতি নিজ প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থীকে যৌনহয়রানীর অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর ১৪ দিন পরও ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ওই শিক্ষক কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে কর্মরত। এ ঘটনায় শিক্ষাবোর্ড থেকে বিভাগীয় কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকসহ অন্য শিক্ষকদের মধ্যেও চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. জামাল নাছের ও সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ অনিয়ম করে বিএনপি ও জামাতপন্থী কর্মচারীদের বিশেষ জায়গায় বদলি করার জন্য মরিয়া হয়ে গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের চাকরিকালীন মেয়াদ অল্প সময় আছে বিধায় বিপুল অংকের লেনদেন এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির আত্মীয়-স্বজনকে সনদ শাখায় ২ জন, কম্পিউটার শাখায় দুইজন, স্কুল রেজিস্ট্রেশন শাখায় একজন, বাসা বাড়িতে একজন নিয়োগ দিয়েছেন।

আরো জানা গেছে, সরকারি নিয়ম-অনুযায়ী কর্মকর্তাদের তিন বছর পর পর বদলির বিধান থাকলেও কুমিল্লা বোর্ডের সচিব নূর মোহাম্মদ এক যুগের বেশি সময় ধরে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে কর্মরত আছেন। তিনি ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি উপ-সচিব (একাডেমিক) পদে যোগদান করেন। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ তাকে সচিব পদে পদায়ন করা হয়েছে। তার (নূর মোহাম্মদ) এর মন্ত্রনালয়ের কোন বদলির কথা শোনা গেলেই অদৃশ্য হাতের ইশারায় তা থমকে যায়। আর নিচের কর্মচারিরা চেয়ারম্যার-সচিবকে মেনেজ করে বিপুল অংকের লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, উপ-কলেজ পরিদর্শক বিজন কুমার চক্রবর্তী, উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহিদুল হক, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উচ্চ মাধ্যমিক) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম একই টেবিলে কর্মরত আছেন।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মচারীরা এ প্রতিবেদককে জানান, আমাদের কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব টাকা ছাড়া কোন ফাইল এ সই করে না। এখানে প্রশাসনিক কোনো শৃঙ্খলা নাই। এক টেবিলে দীর্ঘদিন থাকলে যা-হয়। এখন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। আর এসব ক্ষেত্রে পুরোপুরি সহযোগিতা করেন প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সহিদুল ইসলাম চেয়ারম্যানের কথিত ভাই, উপ-সচিব সাফায়েত মিয়া সচিব নূর মোহাম্মদের ভাগিনা। জনগণের এই শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠানকে এখন তারা মিলেমিশে বানিয়েছেন নিজেদের ব্যক্তিগত আয় ইনকামের উৎস। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য শিক্ষাবোর্ড দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

তারা এ প্রতিবেদককে আরো জানান, ‘১৪ ব্যাচের ২ জন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রফেসর লেভেলের অন্যদিকে- ২০ ব্যাচের একজন এসোসিয়েট প্রফেসর ওনাদের উপরের পদে চাকুরী করে’ বিষয়টি খুবই দঃখজনক। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন নিশ্চই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে প্রফেসর লেভেলের লোকের অভাব নেই। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কেন জুনিয়র সহযোগী অধ্যাপক ‘২০ ব্যাচের’ আসাদুজ্জামানকে (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) এ নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে তোড়পাল চলছে। এ নিয়ে যেন প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এ নিয়ে কুমিল্লার শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা শুধু পদোন্নতি নিয়ে ব্যস্ত বিএনপি-জামাতপন্থী কর্মচারী নিয়ে। এর কারণ সবাই জানে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি (বাশিস) নজরুল ইসলাম রনি বলেন, বোর্ড থেকে প্রেষণে একবার কেউ আসলে আর যেতে চায় না। এখানে মধু আছে। শিক্ষার পুরো কাজ বোর্ডে হয়। টাকা না দিলে কোনো ফাইল নড়ে না। অভিজ্ঞতা না থাকলেও টাকার বিনিময়ে প্রধান পরীক্ষক বানানো হয়। ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও বোর্ড টাকা নিয়ে নির্বাচন দেয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান, স্বীকৃতির অনুমোদন, শাখা খোলা, আসন বৃদ্ধির কাজ টাকা না দিলে বোর্ড করে না। শিক্ষকরা বোর্ডে গেলে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাবেক এক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মন্তব্য করে বলেন, বোর্ডের চাকরি সোনার হরিন। অন্য কোথাও এতো বোনাস নাই। বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারা বছর যা বেতন পায় তার চেয়ে বেশি বোনাস পান। নিবন্ধন, ফরম পূরণ, পরীক্ষার প্রস্তুতি, পরীক্ষা, ফল প্রকাশের কাজে বোনাস দেওয়া হয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক গুদামে গেলেও ভাতা পান। বোর্ড নিজেরা আইন করে এসব সুবিধা নিচ্ছেন। বোর্ডে মিটিং হলে কর্মরত কর্মকর্তারা সিটিং অ্যালাউন্স পায়। যা সম্পূর্ণ বিধিঃবহিভূূত। এগুলো বাতিল হওয়া উচিত।

এই বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি তবে মঙ্গলবার দুপুরে তার একান্ত সচিব আবু আলী মো: সাজ্জাদ হোসেন জানান, বিষয়টি নিয়ে আপনার পাঠানো ক্ষুধে বার্তা মন্ত্রী মহোদয় দেখেছেন এবং এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।

এই বিষয়ে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. জামাল নাছের বলেন, আমার বিষয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট। আগের চেয়ারম্যান এই নিয়োগ প্রক্রিয়া করে গিয়েছিলেন। আমি তা শেষ করতে যাচ্ছি।

এক প্রশ্নে সচিব নূর মোহাম্মদ এর বিষয়ে চেয়ারম্যান আরো বলেন, তিনিও ভালো মানুষ আমার জানা মতে। তবে অভিযোগ তো আর এভাবেই কারো বিরুদ্ধে উঠে না। তিনি (সচিব) দীর্ঘদিন যাবত একই টেবিলে আছেন কোন না কোন ব্যক্তির খুটির জোরে। তাকে নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নাই।

এই বিষয়ে সচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন জবাব দেয়নি।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর