জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মকতারা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অভ্যন্তরীণ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত কোয়ার্টার। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার তুলনায়  ভাড়া বেশি হওয়ায় কোয়ার্টারে থাকার ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছেন এর বাসিন্দারা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট  ২৫৭.১৩ কোটি বাজেটের ২২ কোটি, ২০২১-২২অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২৬৬.২৪ কোটি টাকার বাজেটের ২৮.৫০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের  মোট ২৫৯.৯৭ কোটি টাকার বাজেটের ২৫.৫০ কোটি টাকা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়
থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পট্রোলার অফিস সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ১ম ও ২য় শ্রেণির কর্মকর্তাদেরকে মূল বেতনের অর্ধেক বাড়ি ভাড়া হিসেবে প্রদান করা হয় এবং তৃতীয়  ও চতুর্থ  শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ যথাক্রমে মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ ও ৭৫ শতাংশ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা- কর্মচারীরা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরের বাসবভনে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগার তাদের বেতনের সাথে বাড়ি ভাড়া হিসেবে প্রাপ্ত এ অংশ কেটে নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তর থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আয় করে থাকে যার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের থেকে আদায়কৃত বাড়ি ভাড়ার অর্থ। কিন্তু, ধীরেধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনের প্রতি এমন আগ্রহহীনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রতি আর্থিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে।

জাবি স্টেট অফিস থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫৮৯ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ৪৭৮ টি কোয়ার্টার রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ টি এ-টাইপ কোয়ার্টার অধ্যাপকদের জন্য এবং ৬২ টি বি-টাইপ কোয়ার্টার সহযোগী অধ্যাপক পদ মর্যাদার শিক্ষকদের জন্য নির্মিত হয়েছে।

তবে বর্তমানে ৮৬ টি প্রথম শ্রেণির কোয়ার্টারের মধ্যে ২৩ টি কোয়ার্টারই খালি পড়ে রয়েছে। এছাড়াও ৭৪ টি সি-টাইপ কোয়ার্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক,
সহকারী অধ্যাপক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যার ২৪ টি কোয়ার্টারই খালি পড়ে রয়েছে। আবার সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক এবং প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ডি-টাইপ কোয়ার্টারের ১০০ টির মধ্যে ২০ টিই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এছাড়াও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য নির্মিত ২১৪ টি ই ও এফ টাইপ কোয়ার্টারের মধ্যে ৯২ টিই খালি। এতোগুলা কোয়ার্টার ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ইতোমধ্যে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছয়টি সুউচ্চ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন)  অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আমির হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের প্রতি শিক্ষক, কর্মকর্তা – কর্মচারীদের আগ্রহহীনতার প্রধান কারণ হলো ভাড়ার তারতম্য, আর্থিক বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতেই তারা অন্যত্র থাকায় বেশি আগ্রহী। কেননা, ক্যাম্পাসের আশেপাশে এমনকি ঢাকায়ও কোয়ার্টারের ভাড়ার তুলনায় অনেক কম টাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে তারা থাকতে পারছেন।  মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারগুলোতে মেইনটেন্যান্স ঠিকভাবে হয় না। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ আয় ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, যদি ভাড়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিবেচনা না করে তাহলে নতুন করে তৈরি করা কোয়ার্টারগুলোতেও শিক্ষক, কর্মকর্তা – কর্মচারীরা থাকতে আগ্রহী হবেন না। তখন এই নতুন নির্মিত কোয়ার্টারগুলি নিঃসন্দেহে অপচয় বলে গণ্য হবে। কেননা, সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি সুবিধা ভোগের পর্যাপ্ত সামর্থ্য প্রদানের বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চিন্তা করা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, আবাসিক শিক্ষক ও প্রভোস্টদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট  দুইটি আবাসিক কমপ্লেক্স এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১১ তলা বিশিষ্ট পাঁচটি টাওয়ার চলমান প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ করা হবে। নবনির্মিত এসব আবাসিক ভবনে আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকবে। মূলত বিদ্যমান কোয়ার্টারের ক্ষেত্রে ভাড়ার তুলনায় মানসম্মত কোয়ার্টার  না পাওয়াই এই সমস্যার মূল কারণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা- কর্মচারীরা বলছেন, নতুন করে নির্মিত ভবনগুলোর সুযোগ সুবিধার বিপরীতে ভাড়ার বিষয়টি নতুন করে বিবেচনা না করা হলে
এসব ভবনেও দৃশ্যপট অপরিবর্তনীয় থাকবে। নতুন করে এসব ভবন পুরনো পরিকল্পনার অধীনে উদ্বোধন করা হলে পুরনো ভবনগুলোও ভাগাড়ে পরিণত হবে।

রাজধানীর কলাবাগানে থাকা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র অধ্যাপক জানান, যখন ক্যাম্পাসের আশেপাশে  কোন ১ম শ্রেণির বাসভবন ছিল না এবং পরিবহন
ব্যবস্থাও অনুন্নত ছিল তখন সপরিবারে কোয়ার্টারে থেকেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকতে আমাকে বেতনের সিংহভাগ ব্যয় করতে হতো। অথচ ঢাকার আবাসিক এলাকায় থেকেও সেই খরচের এক তৃতীয়াংশ সাশ্রয় করা যায়।

তিনি আরও জানান, নতুন শিক্ষকদের সংকুচিত বেতনের অর্ধেক শুধুমাত্র বাড়ি ভাড়ার জন্য ব্যয় করা খুব কঠিন ব্যাপার। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরের আবাসন সুবিধা এবং এর
আশেপাশের সুবিধার সাথে কতৃপক্ষের  তুলনামূলক পুনর্বিবেচনা নির্ভর সিদ্ধান্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদেরকে আবার কোয়ার্টারে ফিরিয়ে আনতে পারে।

সহকারী অধ্যাপক হামীম কামরুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা -কোয়ার্টারের ভাড়ার সাথে সুযোগ – সুবিধা ব্যাপারগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় কর্মচারীদের মাঝে ক্যাম্পাসের আশেপাশে স্থায়ী ঠিকানা তৈরির প্রবণতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ক্যাম্পাসের আশেপাশে বাড়ি নির্মাণ করে সপরিবারে থাকছেন। যা এক্ষেত্রে
একটি প্রধানতম কারণ।

নতুন কলা অনুষদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা জানান, আমার বেসিক ও অন্যান্য ভাতাসহ বেতন মাত্র ২৪ হাজার টাকা। আমি যদি ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকতে চাই
তাহলে বাড়ি ভাড়াবাবদ ব্যয় হয় প্রায় ১৩ হাজারেরও উপরে যেখানে আমি ক্যাম্পাসের বাইরে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায় পরিবার নিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে থাকতে পারছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আমাদেরকে সুযোগ সুবিধা ক্রয়ের সামর্থ্য না দেয় তাহলে আমাদের পক্ষে তো তা গ্রহণ করা সম্ভব না। যদি কোয়ার্টার ভাড়া দিতেই বেতনের বৃহৎ একটি অংশ ব্যয় হয়ে যায় তাহলে পরিবারের খরচ বহন করা তো অনেকাংশেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, বেতন থেকে বাড়ি ভাড়ার অংশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন থেকে কেটে নেয়া হয়। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে এ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর