শেরপুরে মাটি দস্যুদের কবলে হুমকিতে ফসলি জমি

আগে অনাবাদি ভিটে শ্রেণির জমির মাটি কেটে আবাদি জমিতে পরিণত করতো, এখন তার উল্টোটা। রাতের আধারে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে পরিণত করছে পুকুরে। এতে জমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি) নষ্ট হওয়ায় আবাদি জমিগুলো ক্রমশঃ উর্বরতা হারিয়ে ফেলছে। এভাবে মাটি কাটার অবৈধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ফসলের উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ও খাদ্য সংকটের প্রকটতা বাড়বে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া তিন ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করার ভয়ঙ্কর প্রবণতার জমির শ্রেণি পরিবর্তন করায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় অনেক আগে থেকেই চলে আসছে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করার প্রবণতা। চলতি বছর শীত মৌসুমে ফসলের মাঠ শুকনো থাকায় এ সময়টাই বেঁচে নেয় মাটি দস্যুরা। আর এ মাটি কাটার সাথে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয় অনেক ইউপি চেয়ারম্যান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, ইউপি সদস্য, সাবেক সদস্যসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। ইটভাটা মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কিছু জমির মালিক না বুঝে টাকার লোভে নিজেদের জমির মাটি বিক্রি করে দেন। অভিযোগ আছে, জমির মালিককে না জানিয়েও রাতের আঁধারে কেটে নেওয়া হয় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি। মাটি কাটা চক্রের সদস্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহসও পান না জমির মালিকরা। আবার স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ ও ইউনিয়ন ভিত্তিক দায়িত্বরত পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব মাটি কাটা হচ্ছে। তাছাড়া মাটি কাটা ও অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে দ্ব›েদ্বর মিমাংসা বৈঠকও হয়েছে।

স্থানীয়রা অভিযোগে জানিয়েছেন, শেরপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক পয়েন্টে তিন ফসলি জমিতে নতুন-পুরাতন পুকুর খনন চলছে। গত অক্টোবর মাসের প্রথম থেকে চলছে জমিতে পুকুর খননের কাজ। কোন কোন এলাকায় রাতের আঁধারে ফসলি জমিতে মাটিকাটার মহোৎসব চলছে। স্কেভেটর (খননযন্ত্র) মেশিন বসিয়ে জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। এমনকি প্রকৃত জমির মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তৃতীয় পক্ষ মালিক সেজে মাটি বিক্রি করছে। এসব মাটি চক্রের সাথে উপজেলার কুসুন্বি ইউনিয়নের বেলঘড়িয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম, নান্নু মিয়া, শামীম মিয়া, মজনু মিয়া, চন্ডেশরের আকতার হোসেন, গাড়িদহ শিবপুরের আমিনুল, জয়নগরের রুবেল, খামারকান্দির শুভগাছা গ্রামের লাভলু মিয়া, খানপুর ইউনিয়নের নলবাড়িয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম, কাফুরার আইয়ুব আলী, শাহবন্দেগী ইউনিয়নের আব্দুল খালেক এর খাজাবাড়িয়া, সাধুবাড়ি গ্রামের পান্না মিয়া, আইয়ুব আলী, হামিদুল হক ভান্ডারী, উচরং গ্রামের ইউপি সদস্য সোহেল, নির্মল চন্দ্র ,অজয় চন্দ্র, তালতা গ্রামের রঞ্জু মিয়া, খোট্টাপাড়ার মাসুদ রানা, শাহীন ও সেলিম, ঘোলাগাড়ি গ্রামের হাফিজার রহমান, আহম্মদ আলী, মির্জাপুরের আব্দুল মজিদ, আলতাফ আলী, আলম ফকির, আব্দুল হান্নান ও আব্দুল মান্নান, মাকড়কোলার আব্দুল কায়েস, ভবানীপুরের ছোনকার নয়ন মিয়া. আব্দুল মান্নান, নন্দতেঘরি গ্রামের জামাল উদ্দিন, ভাবনীপুরের ঘোগা ও হাসরা গ্রামেও মাটি কাঁটা হচ্ছে। বিশালপুর ইউনিয়নের পুরাতন পানিসারা গ্রামের বাবলু মিয়া, কচুয়াপাড়া বাদশা মিয়া, জামাইল গ্রামের সাবেক শহিদুল মেন্বার, পাঁচদেউলি আইনুল, শাহ-নগরের রেজাউল ও আজাদ, ভাদারের নুরু মিযা, শামীম হোসেন, সিরাজনগর গ্রামের রফিকুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যাক্তিরা প্রতিদিন অবৈধ ভাবে হাজার হাজার ট্রাক মাটি কেঁটে চলেছে। প্রতি গাড়ি মাটি বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা।

তবে এসব মাটি বহনকারী ড্রাম ট্রাকের অবাধে চলাচলে রাস্তাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। ফলে গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নে রাস্তাগুলোর সংস্কারকাজ দৃশ্যমান হচ্ছেনা। এতে গচ্ছা যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। তাছাড়া মাটি দস্যুদের খনন করা জমি ও পুকুরের পাড় ঘেঁষা অনেক সাধারণ মানুষের বাড়ী-ঘরগুলোও হুমকির মুখে পড়ছে। তবে এসব স্থানে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ভূমিদস্যুদের মাটিকাটার মহোৎসব চলে। অবৈধভাবে মাটি কাটা বন্ধে এলাকাবাসীরা স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না।

অপরদিকে আবাদী জমিগুলো অনাবাদি হয়ে পড়ায় কৃষিজীবী পরিবারগুলো আছে চরম অনিশ্চয়তায়। দিনদিন মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বাড়লেও নির্বাক প্রশাসন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মাটি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসন,সবাইকে ম্যানেজ করে তারা ব্যবসা করছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা আক্তার জানান, ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কাটার ফলে জমির খাদ্য গ্রহণের হার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলি জমির ওপরে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি থেকে ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত যে মাটি থাকে এটি কেটে নষ্ট করা হলে তা কৃষি ও কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ। এসব মাটি কাটলে তা পুনরায় ফিরে আসতে প্রায় ৫-৬ বছর সময় লাগে। আর বারবার তা কাটা হলে ওই জমি স্থায়ীভাবে ফসল উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও মাটিতে যে অনুজীব থাকে সেগুলোর কার্যাবলীও নষ্ট হয়ে যায়। মাটির জৈব শক্তি কমে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়ছে জমিগুলো। ইটভাটাগুলোতে জমির উপরিভাগের মাটি কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনের সবগুলো সমন্বয় সভায় তা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হয়। তবে মাটি কাটা বন্ধে তেমন দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ দেখা যায়না বলে ওই কর্মকর্তা দাবী করেন।

এ ব্যাপারে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, মাটি ব্যবসায়ীদের প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মাটি বহন করা ট্রাক জব্দ করেছি। তবে দিনের বেলায় তো কাটেনা, রাতের আধাঁরে গোপনে কাটে বলে শুনতে পাই, কিন্তু নানা বাধ্যবকতায় অনেক সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয়না বলে দাবী করে ওই কর্মকর্তা।

বার্তাবাজার/জে আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর