শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে জোরপূর্বক দায়মুক্তিপত্র লেখানোর অভিযোগ জাবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে

‘অনৈতিক সম্পর্ক’ স্থাপন ও শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের দায়ে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের পক্ষে ‘দায়মুক্তি’ পত্র লেখানোর অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্যাগকারী সহকারী প্রক্টর মাহমুদুর রহমান জনি। তার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত প্রাথমিক সত্যাসত্য তদন্ত চলমান রয়েছে। জনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি।

একই বিভাগের ৪৩ ব্যাচের ভুক্তভোগী ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি পাবলিক হেল্থ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ৪৩ তম আবর্তনের একজন শিক্ষার্থী এবং একজন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী। আমি বিভিন্ন সময়ে পাবলিক হেল্থ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনি এবং তার স্ত্রী পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নন্দিতা সরকার এ দুজনের দ্বারা বিশেষত মাহমুদুর রহমান জনির দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং সর্বশেষ সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও নির্যাতিত হয়েছি।’

ভুক্তভোগী দাবি করেন, ‘সামাজিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে নন্দিতা সরকারের সম্পূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং কিছুদিন আগে নভেম্বরের দিকে যখন এই সকল ঘটনাগুলো ঘটেছিল তখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার এবং মাহমুদুর রহমান জনির সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিস (অডিও ও স্ক্রীনশট) প্রকাশিত হয়েছিল। আর এসব প্রকাশ করেছিলেন নন্দিতা সরকার সে বিষয়ে আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।’

অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন পরবর্তী বিয়ের প্রলোভনের বিষয়ে ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান জনি বিভিন্ন চাপের মুখে পড়ার পর আমি যেন বিষয়টি স্বীকার না করি সেজন্য আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় এবং বলে যদি এসব কিছু ঠিক হয়ে যায় তাহলে সে আমার কাছে ফিরে আসবে এবং সামাজিক স্বীকৃতি দিবে। আমাকে শুধুমাত্র এই বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার কাছ থেকে ভিসি বরাবর চার পৃষ্ঠার একটি দায়মুক্তিপত্র লিখিয়ে নেয় এবং যথারীতি সে একজন প্রতারক। তার প্রতারণা এরপরেও অব্যাহত থাকে। এমতাবস্থায় সব সত্য বিষয়গুলো আমি সবার সামনে আনতে চাই এবং আমি চার পৃষ্ঠার এই দায়মুক্তি লিখে দিয়ে লন্ডনে চলে যাই।’

তদন্ত কমিটি দায়মুক্তিপত্রের মাধ্যমে ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে এই শঙ্কা থেকে ওই ছাত্রী বলেন, ‘পরে এই ঘটনার তদন্ত কমিটির কাছে চার পৃষ্ঠার এই দায়মুক্তিপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে বলে আমি জানতে পেরেছি এবং তারা এই দায়মুক্তি পত্রের উপর ভিত্তি করে মিস লিড হচ্ছে। কিন্তু আসল সত্যটা সবার জানা উচিত বলে আমি মনে করি এবং সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত। তাই আমি সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে বিবেকের তাড়নায় অন্তত সত্যটুকু যেন সবাই জানতে পারে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের কাছে সাহায্য চাচ্ছি।’

ভুক্তভোগীকে নির্যাতনের বিষয়ে মাহমুদুর রহমান জনির স্ত্রী নন্দিতা সরকার বলেন, ‘ওই নারী যেহেতু আমার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি, তাই এই ব্যাপারে কথা বলব না।’

মূল অভিযুক্ত জনির সাথে একাধিকবার মুঠোফোন ও বিভাগে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও গণমাধ্যমে তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘গত ২৪শে নভেম্বর এই চার পৃষ্ঠার দায়মুক্তিপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনের নিচতলায় তৎকালীন সহকারী প্রক্টর মাহমুদুর রহমান জনির উপস্থিতিতে অর্ধেক লেখা হয়। সেখানে প্রক্টরিয়াল বডির আরও দুই সদস্য উপস্থিত ছিলো। ঘটনাটি জোড়পূর্বক সংঘটিত হওয়ার সময় ক্যাম্পাসের একদল সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে ভুক্তভোগীকে কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষক আড়ালে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসের বাইরে অন্য স্থানে উপাচার্য বরাবর এই আবেদনপত্র সম্পূর্ণ হয়।’

এদিকে গত ১৬ই জানুয়ারি ভুক্তভোগী স্বাক্ষরিত ৫ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্র উপাচার্য বরাবর সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। ‘ইতোপূর্বে ২৪ নভেম্বর ২০২২ ইং তারিখে আপনার বরাবর আমি যে লিখিত দরখাস্ত দিয়েছি তা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে’ শীর্ষক আবেদনপত্রের ৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়, ‘জনি আমাকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান এবং প্রক্টর স্যারের কাছে পরামর্শ নেওয়া হয় কিভাবে দরখাস্ত লেখা যায়। প্রক্টর স্যার কিছু পয়েন্ট বলে দেন এবং গুছিয়ে লিখতে বলেন। আরেকজন সহকারী প্রক্টর মহিবুর রৌফ শৈবাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। লেখার সময় কিছু সাংবাদিক প্রক্টর অফিসে চলে আসে তাই আমাকে বের করে নিয়ে অন্যত্রে নিয়ে যাওয়া হয় শৈবাল স্যারের গাড়িতে। এরপর বাকি লেখা সম্পন্ন করা হয়। পরেরদিন প্রক্টর স্যারের বাসায় আপনার (ভিসি) অনুমতিতে জমা দিয়ে আমি লন্ডন চলে যাই।’
জোড়পূর্বক লেখানোর বিষয়ে সহকারী প্রক্টর মহিবুর রৌফ শৈবাল বলেন, ‘তাকে কেনো প্রেসার দিয়ে লেখাতে যাব, সে নিজেই প্রক্টরের বাসায় স্যারের কাছে জমা দিয়েছে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। প্রক্টর স্যারকে জমা দিয়েছে, স্যার ভালো বলতে পারবে।’

দায়মুক্তিপত্র লিখে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই লেখিনি। এরকম আমি কিছুই করিনি। আমি এর মধ্যে নাই। আমি আমার পরিবারের বাইরে এখন কোনও কিছুর মধ্যেই নাই।’

‘চাপ প্রদানের’ অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘চাপে ফেলে কাউকে কোন কিছু লেখায়নি এবং কী লিখেছে, কী লেখেনি আমি কোন কিছুই জানি না এবং লেখার সময়ও আমি ছিলাম না। অফিস বন্ধ থাকায় আমার বাসায় একটি মুবন্ধকরা একটি চিঠি নিয়ে আসে। আমি সেটা খুলেও দেখিনি। আমার বাসায় এসে আমার হাতে দিয়ে গেছে, আমি ভিসি বরাবর জমা দিয়েছি। এ ব্যাপারে যেখানে প্রয়োজন হয় সেখানে বলব। আমাকে যদি ডাকে কেউ এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য তখন বলবো। এইটা একেবারে গোপন বিষয়। আমি গোপনভাবে জমা দিয়েছি।’

প্রক্টরের বাসায় ওই নারী একাই গিয়েছিলেন নাকি সাথে অন্য কেউ ছিল?-এমন প্রশ্নে প্রক্টর বলেন, ‘এগুলো একেবারে গোপন কথা। এগুলো তদন্তাধীন বিষয় তো, এগুলো বলা যাবে না। কে ছিল, না ছিল এগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, গতবছরের ৮ই ডিসেম্বর ৫ সদস্যের একটি প্রাথমিক সত্যাসত্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। যার আহ্বায়ক মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার খসরু পারভেজ। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে রয়েছে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার, গণিত বিভাগের অধ্যাপক জেসমীন আখতার, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক উম্মে সায়কা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (আইন) মাহতাব-উজ-জাহিদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ভিসি অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, ‘দায়মুক্তি পত্রটি আমি পেয়েছি কিন্তু ভুক্তভোগী সরাসরি আমাকে দেয় নি। এটা আমাকে ব্যাক্তিগতভাবে দিয়েছে তাই আমি এটা নিয়ে কাউকে কিছু বলবো না।’ দায়মুক্তিপত্র তদন্ত কমিটির কাছে প্রেরণ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেয়নি।

বার্তাবাজার/জে আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর