৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩২৬ কোটি

দেশের ব্যাংক খাতে ক্রমেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এর বিপরীতে আদায় বাড়ছে না। সদ্য বিদায়ী বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। একই সময়ে খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৩৫৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশির ভাগ টাকা ফেরত না দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে এসব বড় ঋণ নেওয়া হয়। এখানে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে- ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করে। তারা জানেন, এসব ঋণের ৯০ শতাংশ ফেরত আসবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণের অংক বাড়ছে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল জায়গায় এসব ঋণ দেওয়া হয়। আবার ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সঠিক আইন প্রয়োগ না হওয়া। শুধু আইন সংস্কার করলেই হবে না, তা প্রয়োগেও কার্যকর ভূমিকাও রাখতে হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক করোনা মহামারির সময় ব্যাংক ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় ও সুবিধা দেওয়া হয়। আবার গেল বছরের শুরুতে তা তুলে নেওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

ব্যাংকাররা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উদাসীনতাও দায়ী। অন্যদিকে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবেও খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে ঋণ আদায়ে এর প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকায়, গত ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল প্রায় এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে নয় মাসে আদায় না হওয়া মন্দ ও পুনঃতফসিল করা ঋণসহ খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ৩২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। বিপরীতে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৩৫৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ব্যাংকের কিছু ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়। এসব ঋণ মামলায় আটকে রয়েছে। আবার পুনঃতফসিল সুবিধাও নিচ্ছে। এসব সুবিধা নিচ্ছে বড় ঋণগ্রহীতারা। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া এবং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেওয়া।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল জায়গায় এসব ঋণ দেওয়া হয়। আবার ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সঠিক আইন প্রয়োগ না হওয়া। শুধু আইন সংস্কার করলেই হবে না, তা প্রয়োগেও কার্যকর ভূমিকাও রাখতে হবে।’

তথ্যমতে, গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নয় হাজার ১৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর সঙ্গে আদায় না হওয়া মন্দ ও পুনঃতফসিল করা ঋণ যুক্ত হওয়ায় নতুন খেলাপি ঋণ হয়েছে ১৩ হাজার ৭৯২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮৭৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) সময়ের চেয়ে এ আদায় অনেক কম। ওই সময় নগদ আদায় হয়েছে তিন হাজার ৮৫৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে আদায় কমেছে এক হাজার ৯৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রথম প্রান্তিকে আদায়ের অংক ছিল এক হাজার ৬২২ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব শিথিলতা দিয়েছে, তা কমিয়ে আনা উচিত। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোর বার্তা দেওয়া উচিত। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে।
আনিস এ খান, সাবেক এমডি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সম্মিলিতভাবে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নতুন করে সাত হাজার ৫২৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে। এ সময় খেলাপি থেকে নগদ আদায় হয়েছে ৪৬৯ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট খেলাপি ছিল ৬০ হাজার ৫০১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ছয় হাজার ৪৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তাদের আদায়ের অংক ছিল এক হাজার ২০৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এসব ব্যাংকে সেপ্টেম্বর শেষে মোট ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা খেলাপি দাঁড়ায়।

অপরদিকে বিদেশি ব্যাংকের নতুন করে খেলাপি হয়েছে ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এসব ব্যাংক আদায় করেছে ৩৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৯৭০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দাঁড়ায়। এ সময় বিশেষায়িত ব্যাংক খেলাপি থেকে আদায় করে ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপির অংক দাঁড়ায় চার হাজার ২৭৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকায়।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘যে হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, সেই তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে শিথিল নীতি। ফলে দেখা যাচ্ছে, খেলাপি বাড়ছে, আদায় কম হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব শিথিলতা দিয়েছে, তা কমিয়ে আনা উচিত। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোর বার্তা দেওয়া উচিত। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে।

বার্তাবাজার/জে আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর