কমেই চলেছে রিজার্ভ

চলতি বছরের শুরু থেকে কমতে থাকা রিজার্ভ নিয়ে কোনো সুখবর শিগগিরই আসছে না। ক্রমে কমে চলেছে রিজার্ভ। বাণিজ্যের উচ্চ চাহিদার কারণে প্রতিদিন ডলার খরচ অব্যাহত রয়েছে। গত ১৬ মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমতে কমতে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকলেও দ্রুতই তা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড (আইএমএফ) দেওয়া বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করলে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

চলতি বছরের নভেম্বরে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর থেকে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে যা থাকে সেটিই হচ্ছে নিট রিজার্ভের পরিমাণ। ফলে বর্তমানে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হকের কাছে ২২ ডিসেম্বর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত জানতে চাইলে তিনি জানিয়েছেন, ৩৪.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ( প্রতি ডলারের দাম ১০২ টাকা ৮৪ পয়সা হিসাবে) ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩২৫ কোটি ১৬ লাখ ২৪ হাজার মার্কিন ডলার।

গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ গ্রসে নয়, নিটে দেখাতে বলেছে আইএমএফ। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। যদিও আমরা সাধারণত রিজার্ভ গ্রসে দেখাই। আইএমএফ আমাদের নিট রিজার্ভ দেখাতে বলছে। জবাবে আমরা বলেছি, আমাদের হিসাবের মধ্যেই গ্রস ও নিট রিজার্ভ রয়েছে। চাইলে আমরা আলাদা করে দেখাতে পারি। এ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা সবসময় এ বিষয়ে স্বচ্ছতা রেখেই লেনদেন করি।’

ওই সময় গর্ভনর জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকেরর গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের কয়েকটি ফান্ডে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। সেখান থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ চলে আসবে ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আমাদের যখন রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছিল তখনও আমরা এভাবেই হিসাব করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ইভিএফ যেটা, সেটা ১২০ দিনের জন্য ঋণ দিই। আমরা চাইলে সেটা তুলে নিয়ে আসতে পারি। শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার আমরা আনার জন্য কাজ করছি। শ্রীলঙ্কার গর্ভনরের সঙ্গে আমি বৈঠক করেছি। তিনি বলেছেন, তারা আমাদের লোনটা পরিশোধ করবে।’

গভর্নর বলেন, ‘সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকির ব্যাপারে আইএমএফের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা বলেছি, কৃষি খাত হলো আমাদের প্রধান খাত। এই খাত আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সুতরাং এই খাতে আমরা ভর্তুকি দিয়ে যাব। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে তারা আর কোনো কথা বলেনি।’

আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে আইএমএফের বক্তব্য কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। আইএমএফের শর্তও খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। ফলে এখানে নতুন করে কোনো শর্ত আসেনি। তবে বিভিন্ন ব্যাংকের যে মূলধন ঘাটতি রয়েছে, অর্থাৎ ভেসেল-৩ যে লেভেলে রয়েছে, সব ব্যাংককে সেই স্থানে নিয়ে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অলমোস্ট সবারই ভেসেল-৩ বাস্তবায়ন করা আছে। তবে ৮-১০টি ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে। সেটা আমাদের পূরণ করতে বলেছে। এটা মোট ব্যাংকের সাড়ে ১২ শতাংশ।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০২১ সালের জুনে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়নে উন্নীত হয়। একই বছরের আগস্টে দেশের ইতিহাসে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় রেকর্ড ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে ওই সময় করোনাকালীন লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি বাড়তে থাকে। যা বাড়িয়ে দেয় পণ্যমূল্যও। এর সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজ খরচ বাড়লে পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এরমধ্যে গত ফেব্রয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশেও বৈশ্বিক বাণিজ্যের দায় মেটাতে চাপে পরে। আমদানি ব্যয় বাড়ার বিপরীতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স সেভাবে না বাড়লে ডলারের মজুদে টান পড়ে। এতে করে যুদ্ধ শুরুর চার মাস পর গত জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। চলতি বছরের শুরুতে তা ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ক্রমাগতভাবে কমতে কমতে বর্তমানে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে।

সংকট উত্তোরণে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে গত জুলাইয়ে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফও শর্তসাপেক্ষে এই ঋণ দিতে রাজি। জানা গেছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার পাওয়া যাবে। ৪২ মাস বা সাড়ে তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এই ঋণ ছাড় করা হবে। সাত কিস্তির এই ঋণের সর্বশেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে।

ইতোমধ্যে এক্সটেনডেন্ড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ও এক্সটেনডেন্ড ফান্ড ফ্যাসিলিটির আওতায় ৩.২ বিলিয়ন আর রেজিলিয়ানন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটির ফ্যাসিলিটির আওতায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে। এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের সমষ্টিক অর্থনৈতিক সুরক্ষা, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের চাপ সামলানো আর জলবায়ু সুরক্ষা তহবিলে সহায়তা করা।

আইএমএফএ শর্তগুলো হলো:
– রাজস্ব বাড়ানো এবং যৌক্তিক ব্যয় ব্যবস্থা চালু করা। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। যারা নাজুক অবস্থায় থাকবে, সেসব খাত লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী নেওয়া।

– মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক মুদ্রানীতি তৈরি করা। সেই সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হার আরও নমনীয় করে তোলা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে আধুনিক মুদ্রানীতি।

– আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা, নজরদারি বাড়ানো, সরকার ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা।

– বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পরিবেশে তৈরি, মানব দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা।

– জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, পরিবেশের উন্নতির পদক্ষেপ নেয়া এবং জলবায়ু সংক্রান্ত খাতে আরও বিনিয়োগ ও আর্থিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে ঋণের বিষয়ে দ্বিতীয় দফা আলোচনার জন্য আবারও ২০ ডিসেম্বর চার দিনের সফরে সোমবার ঢাকায় আসেন আইএমএফ-এর নির্বাহী পরিচালক ড. কৃষ্ণমূর্তি ভি সুব্রামানিয়ান। মঙ্গলবার ২০ ডিসেম্বর থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে বৃহস্পতিবার ঢাকা ত্যাগ করেন এই আইএমএফ কর্মকর্তা। আগামী বছরের শুরুতে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকও বাংলাদেশ সফরে আসবেন।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর