১৬ ডিসেম্বর আর ২৬শে মার্চ ‘আমাগো ঈদ’

‘১৬ ডিসেম্বর আর ২৬শে মার্চ আইলেই আমাগো ঈদ লাগে ভাই। এই দুইদিন ম্যালা টেকার (অনেক টাকা) ফুল বেঁচতে পারি। হেই টেকা দিয়া পোলা মাইয়া নিয়া পোলাউ মাংস রাইন্ধা (রান্না) খাই।’ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস সামনে রেখে এভাবেই নিজের উচ্ছাস প্রকাশ করছিলেন ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতা রোজিনা বেগম।

বৃহস্পতিবার সকালে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমস প্রতিবেদকের। এসময় তিনি জানান বছর তিনেক আগে তার স্বামী তাকে রেখে অন্যত্র সংসার পেতেছেন সেই থেকেই দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার জীবন যুদ্ধ শুরু। ছোট তিন সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকেন সাভারের কুঁড়গাও বটতলা এলাকায়। আর প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্মৃতিসৌধের সামনে ফুল বিক্রি করে চালান পেট।

বছরের বাকি দিনগুলোতে কোনরকম বেচাবিক্রি হলেও ১৬ ডিসেম্বর মহান মহান বিজয় দিবস ও ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে তার ফুল বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই এই দুটো দিন তার কাছে ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দময় বলে জানান তিনি।

তারমতো একই সুরে কথা বললেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পঙ্গু লায়লাবানু নামে আরেক ফুল বিক্রেতা মহিলা। তিনি জানান ২০ বছর বয়সে স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে হারিয়ে ফেলেছেন স্বাভাবিকভাবে চলাচলের ক্ষমতাটুকু সেই থেকে একাই রয়ে গেছেন এই নারী।

সংসার বলতে বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছাড়া আর কেউ নেই তার। ভাইয়েরা বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন বেশ আগেই, এখন কোনো খোঁজ খবর রাখেন না তাদের। সেই ক্ষোভে বৃদ্ধা মা-বাবাকে নিয়ে বগুড়ার নিজ এলাকা থেকে থেকে পাড়ি জমিয়েছেন আশুলিয়ার শ্রীপুর এলাকায়।

প্রতিদিন সকালে লোকাল বাসে চরে ফুল বেঁচতে এসে দাঁড়ান স্মৃতিসৌধের সামনে। সারাদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে বিক্রি করেন কয়েক জাতের বাহারী রঙিন ফুল। দিনশেষে তার আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো। এই দিয়েই কোনমতে জীবন যাপন তার। তবে আগামীকাল বিজয় উপলক্ষে তার মুখেও হাসির ঝিলিক।

তিনি জানান এই বিশেষ দিনে তার ফুল বিকিকিনির পরিমাণ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। গতমাসে ২ হাজার টাকা ঘরভাড়া বাকি পরেছে তার আশা আগামীকালের ফুল বিক্রির টাকাতেই সেই ধার তিনি শোধ করে ফেলবেন।

কেবল রোজিনা আর লায়লাই নয়। স্মৃতিসৌধ এলাকায় তাদের মতো ফুল বিক্রি করেন এমন আরো ডজন খানেক মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে হাসান আর রায়হানের মতো ছোট ছোট বেশকিছু শিশু বাচ্চাও।

হঠাৎ তাদের মধ্যেই রায়হান নামে ৪ বছরের এক শিশু হাতে একটি লাল গোলাপ এগিয়ে ধরে বলেন ভাই কিনেন এইটা বাইত (বাড়িতে) নিয়া আপারে দিয়েন।

এই বয়সে ফুল বিক্রির কারণ জানতে চাইলে সে বলে উঠে, বাবায় আমাগো ভাত দেয়না তাই ফুল বেইচ্চা মায়েরে টেকা দেই। আমার মায়ে বাসা বাড়িত কাম করে।

বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে যে জানায়, এই দিন ম্যালা মাইনষে (অনেক মানুষ) আহে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে। হেগো মইধ্যে অনেকে আমারে ৫০/১০০ কইরা টেকা দেয় এতে আমার অনেক রোজগার হয়।

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে চোখে পরে ফুট ওভার ব্রিজের নিচের সিড়িতে বসে কচকচে বেশকিছু কাগুজে নোট গুণছে হাসান নামে আরেক শিশু ফুল বিক্রেতা। কাছে এগিয়ে এতো টাকা দিয়ে কি করবে জানতে চাইলে অনেকটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে তার গালদুটো। তারপর উত্তর দেয় গত এক সপ্তাহে ফুল বিক্রির একটি টাকাও খরচ করেনি সে। কারণ সেই টাকা জমিয়ে আগামীকাল ১৬ই ডিসেম্বর অনেকগুলো ফুল কিনবে বিক্রির জন্য। এরই মাঝে আগামীকাল ভালো লাভের আশায় তার মুখেও ফুটে উঠেছে মুচকি একটুকরো শুভ্র হাসি।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর