দেশের তরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫১ বছরেও মেলেনি কিশোরী রানীর মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি

একাত্তরের ডিসেম্বর। শীতের কুয়াশা মোড়ানো সন্ধ্যা। স্থান ভারতের সোনামুড়া। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাতে হবে পিস্তল, গুলি। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারাও সতর্ক। তাই গৃহবধূ কিশোরী রানী শর্মা রান্নার পাতিলে ভাতের ভেতরে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন অস্ত্র ও গুলি। কিন্তু রেহাই মেলেনি। আচমকা পাকিস্তানিরা দূর থেকে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে রানী শর্মা পড়ে যান গোমতী নদীতে। স্রোতের টানে ভেসে যান অনেক দূর। মৃত ভেবে পাকিস্তানি হানাদাররা চলে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা এসে উদ্ধার করেন তাকে। ক্যাম্পে নিয়ে গুলি বের করেন। বাম হাতের কনুইয়ের ওপর গুলির দাগ আজও সেই সন্ধ্যার বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দেয়।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার মধ্যম বিজয়পুরে কিশোরী রানী শর্মার বাড়িতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথোপকথনে মুক্তিযুদ্ধের সে ভয়াল সন্ধ্যার কথা বলতে বলতে শিউরে উঠছিলেন। জানালেন, তার স্বামী অরুণ প্রসাদ শর্মাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নতুন অস্ত্র তৈরি ও বিকল অস্ত্র ঠিক করার দায়িত্ব ছিল তার। মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে কাজ করলেও স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও এই দম্পতির কেউই পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। মনে চাপা কষ্ট নিয়েই বছর দশেক আগে পরপারে পাড়ি জমান অরুণ প্রসাদ। কিশোরী রানীও বেঁচে আছেন কোনোক্রমে।

কিশোরী রানী শর্মা জানান, তার জন্ম ১৯৩৭ সালে। ২৪ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। বছর চারেক আগে তার একমাত্র ছেলে বাসু প্রসাদ শর্মা ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে এখন বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায় কাজ করেন। বেতন পান পাঁচ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই খেয়ে-পরে দিন কাটাচ্ছেন তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরী রানীর বাড়ির সামনে একটি খাল। নড়বড়ে সাঁকো পার হয়ে সামনে গেলেই ছোট্ট একটি টিনের ঘর। সেখানেই শুয়ে আছেন কিশোরী রানী শর্মা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসতেই উঠে বসলেন। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘শীতের রাতে কতবার বিবিরবাজার বর্ডার ক্রস করে ভারতের সোনামুড়া গেছি। সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ হতো। প্রতিবার পাকিস্তানি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে কত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছি। গুলি খেয়ে নদীতে পড়ে গেছি। তবুও মুক্তিযুদ্ধ করে গেছি।’

এরপরই আফসোস ঝরতে লাগল কিশোরী রানীর কণ্ঠে। বলেন, ‘আমরা মেজর এনামের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছি। অথচ আজ আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। আমার ছেলেটা মারা গেল। একমাত্র মেয়ে আর ছেলের ঘরের নাতি-নাতনিদের নিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি। কেউ আমাদের খবর রাখে না। আমার স্বামী বেঁচে থাকতে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন। আমিও করেছি। কেউ আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি।’

মেয়ে পান্না রানী শর্মা বলেন, ‘মাকে নিয়ে কত কষ্টে আছি, কেউ না এলে বুঝবেন না। অথচ যুদ্ধ করার সময় কোনো শর্ত ছিল না। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বিনা শর্তে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন আমার মা-বাবা। আজ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে কত শর্ত মানতে হয়, এর চেয়ে দুঃখের কী আছে! আমি আশা করব, এক দিন প্রধানমন্ত্রী ঠিকই আমার মা-বাবাকে স্বীকৃতি দেবেন। কারণ, পৃথিবীতে অনেক সত্য আছে, যেগুলোর জন্য প্রমাণ লাগে না।’

বীরত্বের স্বীকৃতি না পাওয়াকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশিস ঘোষ। তিনি বলেন, ‘আমি কিশোরী রানীর জীবনের ঘটনা শুনেছি। তিনি ও তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তবে যথাযথ নথিপত্র সংরক্ষণ করতে পারেননি বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। তবু আমি আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন তার এই ত্যাগের বিষয়টি মূল্যায়ন করে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। সেখানে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও যদি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তার স্বীকৃতি না পান, সেটি হবে দুর্ভাগ্যজনক।’

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, ‘ভারতীয় তালিকা, দেশের গেজেট ও লাল তালিকায় কিশোরী রানী এবং তার স্বামী অরুণের নাম নেই। তাই তাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া যাচ্ছে না। তবে তারা যদি মন্ত্রণালয় বা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) গিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।’

অপরদিকে একই জেলার মুরাদনগর উপজেলার কাজিয়াতল গ্রামের বীর মুক্তিযুদ্ধা করপোরাল অব. আবদুল মতিন চৌধুরী যুদ্ধাহত হয়ে তার নাম রয়েছে সাধারণ মুক্তিযুদ্ধা তালিকায় তবে নাম থাকার কথা ছিলো যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধার তালিকায়।

এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন চৌধুরী বলেন যুদ্ধের সময় আমার বামপায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধাহত হই এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে পর্যাপ্ত প্রমানাদি দেয়ার পরও আমার নাম যুদ্ধাহত গেজেটে অন্তর্ভূক্তি নেই। প্রশাসনের গাফলতি ও উদাসীনতার কারনেই এমন হচ্ছে বলে জানান তিনি।

শরিফুল/বার্তাবাজার/জে আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর