গাছের বোবা কান্না

গাছেরও প্রাণ আছে, আছে অনুভূতি শক্তি।বিজ্ঞানের কল্যাণে এ কথা আজ আর কারো অজানা নয়। মানুষের শরীরে পেরেক ঠুকলে যেমন কষ্টের অনুভূতি হয় ঠিক সমপরিমাণ কষ্ট অনুভূত হয় গাছেরও। এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতা এবং প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার জন্য প্রধান যে উপাদানটি প্রয়োজন তা হচ্ছে অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেন উৎপন্নের প্রধান উৎসই হচ্ছে এই গাছ।

গাছ পরিবেশ থেকে ক্ষতিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। সেই অক্সিজেন গ্রহণ করেই এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে মানব সভ্যতা তথা প্রাণিকুল। গাছ মানুষকে অক্সিজেন, ফুল, ফল, ছায়া ও কাঠ দিয়ে যেমন সহযোগিতা করে অন্যদিকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা করে। গাছ নিজেকে নিঃস্বার্থে বিলিয়ে দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে; অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই গাছকেই আমরা ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রতিনিয়ত নানানভাবে অত্যাচার, নির্যাতন করি। ফুল-ফল ও পাতা ছিঁড়ে দেই আবার কোথাও কোথাও বড় বড় লোহার পেরেক বিদ্ধ করে গাছের শরীরে ব্যানার, ফেস্টুন ও সাইনবোর্ড টাঙানোর মহোৎসবে মেতে উঠি।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি গাছ সারা জীবন যে পরিমাণ অক্সিজেন দেয় তা সিলিন্ডার করে বিক্রি করলে তার বাজার মূল্য দাঁড়াবে কয়েক কোটি টাকা। অথচ সাম্প্রতিককালের করোনা মহামারী অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা ও অক্সিজেন স্বল্পতা সমস্ত বিশ্ববাসিকেই হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। বিষয়টা একেবারেই স্পষ্ট যে গাছ না থাকলে অক্সিজেন শুন্য এই পৃথিবীতে মানুষ কিংবা কোনো প্রাণীকুলের অস্তিত্ব টিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কখনোবা জীবিকার তাগিদে মহামূল্যবান এসব গাছ কাটার মহোৎসব চলছে সর্বত্র।

গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড লাগানো দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ২০০২ সালের ৭ জুলাই জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়; আইন পাস হওয়ার পরও সে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই বললেই চলে।ফলে গাছের শরীরে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন প্রচারের প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে সারা দেশে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চা বেষ্টিত জেলা হবিগঞ্জ সদর উপজেলাসহ সমস্ত উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা, শ্রীমঙ্গল ভটের মিল,রাজনগর, কুলাউড়া সহ খোদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর নিজ এলাকা বড়লেখা শহরের আশপাশ, স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতাল এলাকার সড়কের পাশে গাছে গাছে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার অসংখ্য ফেস্টুন ও ব্যানার। ফেস্টুনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, ক্লিনিক, চিকিৎসক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারণা। গাছের বাকশক্তি ও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, তাই যে যার ইচ্ছে মতো নির্মমভাবে গাছে পেরেক বিদ্ধ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রায় সারাবছরই পেরেক ঠুকে গাছে টাঙানো হয় ফেস্টুন, ব্যানার।

তবে ইদানিং হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার প্রায় সবকটি উপজেলাতেই বৃক্ষের গায়ে পেরেক মেরে ফেস্টুন লাগানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনের সময় প্রায় এলাকাতেই পেরেক ঠুকে বৃক্ষে ফেস্টুন ব্যানার লাগানোর মহোৎসব চলে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ প্রচার-প্রচারণার জন্য ফেস্টুন বানিয়ে পেরেক ঠুকে গাছের শরীরে নির্বিঘ্নে লাগিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো এলাকার সড়কের পাশের গাছ ও স্কুল-কলেজের সামনের গাছ এমনকি সরকারি আধাসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের গাছগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই এমন নির্মম দৃশ্য এখন অহরহ দেখা যায়। প্রতিটি গাছে ১৫-২০টি লোহার পেরেক আবার কোনো কোনো গাছে তা দ্বিগুন তিনগুন পরিমাণে বিদ্ধ করতেও দেখা যায়।

গাছ নিঃস্বার্থে মানব সভ্যতা তথা প্রাণীকুলের টিকে থাকার জন্য সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি বিশুদ্ধ অক্সিজেন বিলিয়ে যাচ্ছে।অথচ একশ্রেণীর মানুষ সেই জীবন রক্ষাকারী গাছের শরীরে লোহার পেরেক বিদ্ধ করে তাদের ব্যাক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে দিনের পর দিন। গাছের শরীরে লোহার পেরেক বিদ্ধ করার ফলে গাছের গায়ে অসংখ্য ছিদ্র হচ্ছে। আর সেই ছিদ্র দিয়ে পানি ও বাতাস প্রবেশ করে গাছে পচন ধরে হাজার হাজার গাছের মৃত্যু হচ্ছে। গাছে লোহার পেরেক বিদ্ধ করে বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে শরীরে পচন ধরে মৃত্যুর তালিকায় শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত অনেক গাছও রয়েছে। গাছে নির্মমভাবে লোহার পেরেক ঠুকার কারণে মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার গাছ। এমনিতেই একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য।

কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারি হিসেবে অনুযায়ী ১৭ শতাংশ হলেও বাস্তবে তা নেই।বাস্তবে মোট যে পরিমান বনভূমি রয়েছে দেশের জনসংখ্যা ও আয়তনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। দিন দিন বনভূমির পরিমাণ আরও কমে যাচ্ছে। শুধু মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলা-ই নয়, প্রায় সারা দেশেই গাছে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন ও ফেস্টুন টাঙানোর এ প্রতিযোগিতা বাড়ছে বৈ কমছে না। যা পরিবেশের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় ধরণের অশনি সংকেত।

এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে বনবিভাগ এমনকি পরিবেশ রক্ষায় গঠিত সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনদেরকেও উক্ত বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে এই দেশ একদিন মানুষতো দূরে থাক প্রাণীকুলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে । বৃক্ষহীন হয়ে পড়বে পরিবেশ। নেমপ্লেট বা সাইনবোর্ড সাঁটানোর একান্তই প্রয়োজন হলে গাছের গায়ে তার বা রশি দিয়ে বেঁধে রাখলেও পেরেকের নির্মম আঘাত থেকে বেঁচে যায় গাছগুলো। একইসাথে বেঁচে যায় আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ।সুতরাং আর দেরি নয় এখনই আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে গাছেরও জীবন আছে। মানুষের শরীরে লোহার পেরেক ঠুকে দিলে যেমন কষ্ট অনুভূত হয় ঠিক সমপরিমাণ কষ্ট অনুভূত হয় গাছেরও। একটিবার ভেবে দেখুনতো যে বৃক্ষ মানব সভ্যতা কিংবা প্রাণীকুলের টিকে থাকার জন্য নিঃস্বার্থে জীবন রক্ষাকারী বিশুদ্ধ অক্সিজেন বিলিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই জীবনরক্ষাকারী গাছগুলোকে আমরাই পেরেকের নিষ্ঠুর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। লোহার পেরেকে বিদ্ধ হওয়া গাছগুলোর সেই বোবা কান্নাটা একটু শুনার চেষ্টা করুন।

আজ থেকে বৃক্ষের গায়ে আর একটি পেরেকও নয়। মানব সভ্যতা কিংবা প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করে হলেও গাছ রক্ষায় সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। পাশাপাশি বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির পাশে ফেলে রাখা পরিত্যাক্ত ভূমি ফেলে না রেখে গাছ রোপন করুন। এই গাছই আপনার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনার সাথে সাথে মানুষ সহ সমস্ত প্রাণীকুলের জীবন বাঁচাবে। যারা গাছের গায়ে পেরেক লাগায় এবং যারা লাগাতে চায় তাদের প্রত্যেককে সচেতন করে তুলতে হবে। গাছের গায়ে পেরেক মারা বন্ধে বনবিভাগ এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের সুদৃষ্টিও জরুরি।

লেখক: হৃদয় দেবনাথ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর