ইডেনে সিট বাণিজ্যে কোটি টাকা ‘আয়’ ছাত্রলীগের

সম্প্রতি দেশের অন্যতম আলোচিত ইস্যু ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল। শুরুর দিকে অন্তরালে থাকলেও কয়েক দিন আগে কলেজ ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। আপাতদৃষ্টিতে কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে মারধরের ঘটনার জেরে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হলেও এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কলেজের হলগুলোর কক্ষের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এসব কক্ষকে ঘিরেই চলে সিট বাণিজ্য। কলেজ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেত্রীর ভাষ্য, এককালীন কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যরা। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের ভেতরের ক্যান্টিন ও বাইরের ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদাবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারাও অন্তর্কোন্দলের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

তিন পদ্ধতিতে মেলে সিট: কলেজের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনটি পদ্ধতিতে হলে উঠতে হয়। প্রথমত, ছাত্রলীগের পদধারী নেত্রীদের এককালীন টাকা দিয়ে। দ্বিতীয়ত, মাসিক ভাড়া দিয়ে। কেউ কেউ আবার বার্ষিক চুক্তিও করে নেন। তৃতীয়ত, বৈধ পদ্ধতিতে। তবে এ পদ্ধতিতে সিট পাওয়া সহজ নয়। হলের যাবতীয় পাওনা দেওয়ার পরও আবার টাকা দিয়ে নেত্রীদের রেফারেন্সে লিগ্যাল হয়ে রুম পরিবর্তন করে নিতে হয়।

সিট বাণিজ্যের সহজ সমীকরণ: কয়েকজন সহসভাপতি ও সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ছয়টি হলে ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১০০টি রুম। কিন্তু এর বাইরেও রুম রয়েছে বলে অনেক নেত্রীর অভিযোগ। প্রতিটি রুমে ১০ থেকে ১৫ জন করে থাকেন। যদি প্রতি রুমে ১০ করেও শিক্ষার্থী ওঠানো হয়, তাহলে ১০০ রুমে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হবে ১ হাজার জন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এককালীন টাকা দিয়ে উঠেছেন, আবার কেউ মাসিক ভাড়ায়। এ হিসাবে ৫০০ ছাত্রী এককালীন টাকা দিয়ে আর ৫০০ শিক্ষার্থী মাসিক ভিত্তিতে হলে উঠলে এককালীন ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এককালীন শিক্ষার্থীপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে ধরা হলে অঙ্কটা দাঁড়ায় ১ কোটি টাকারও বেশি। মাসিক হিসাবে ভাড়া আদায় করা হলে নেওয়া হয় ২ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। গড়ে আড়াই হাজার টাকা করে ধরা হলে টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা।

কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বক্তব্য: নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রী জানান, এ বছরের ১৩ মে কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হলে যাঁরা পদপ্রত্যাশী ছিলেন, কিন্তু নেতা হতে পারেননি তাঁদের কক্ষগুলো দখল করে নেন সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা এবং সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেত্রী জানান, ইডেন কলেজ প্রশাসন থেকে অনুমোদিত ছয়টি হলে ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ ১০০ রুম। এর ৫০টির নিয়ন্ত্রণে সভাপতি রিভার গ্রুপ, বাকি ৫০টির নিয়ন্ত্রণে সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার গ্রুপ। তাঁদের পছন্দের নেত্রীরা দখল করে রেখেছেন এসব রুম। প্রতিটি রুমে ১০ থেকে ১৫ জন করে ছাত্রী থাকেন। যাঁদের রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রী রুমে তুলে থাকেন।

কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক নেত্রী বলেন, এটি সত্য। এটা কলেজে ওপেন সিক্রেটের মতো। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পলিটিক্যাল রুমগুলো নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চান এবং সিট বাণিজ্য করতে চান।

কলেজ ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছের লোকদের বেশি করে রুম দেওয়া হয়, অন্যরা রুম পান না।

সংঘর্ষের দিন সকালে কলেজের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের সামনে রিভা-রাজিয়ার বিরোধী পক্ষের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রুম বাণিজ্যের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সদ্য বহিস্কৃত কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি দেখেছি, ১০০টি পলিটিক্যাল রুমের কথা বলা হলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অধীনের এরও বেশি রুম রয়েছে। ডিজিএফআই এবং এনএসআইর রিপোর্টে এর সংখ্যা ১২৮টি বলা হয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের বক্তব্য: কলেজের হলগুলোর রাজনৈতিক এবং বৈধ রুমে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক কিংবা বৈধ যে রুমই হোক, ছাত্রলীগ নেত্রীদের টাকা দিতেই হয়। টাকা দিতে না পারলে তাঁদের হলের সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়।

পলিটিক্যাল রুমে থাকা এক ছাত্রী জানান, তিনি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে হলে উঠেছেন। যাঁরা রাজনৈতিকভাবে হলে ওঠেন, তাঁদের টাকা দিয়েই উঠতে হয়। আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ছাত্রীদের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে হলে উঠতে হয়।

বৈধ রুমে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, যদি কেউ সিটের জন্য আবেদন করার পর কলেজ প্রশাসনের তালিকাভুক্ত হয়ে সিট পান, তাহলে তাঁকে টাকা দিতে হয় না। তবে কেউ এই তালিকায় না থাকার পরও যদি ছাত্রলীগের নেত্রীদের কাছে লিগ্যাল সিটে ওঠার বিষয়ে জানান, তাহলে সেই নেত্রী হল প্রশাসনের মাধ্যমে তাঁকে বৈধ সিটে ওঠান। তবে এ ক্ষেত্রে ওই নেত্রীকেও এককালীন টাকা দিতে হয়।

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বিভিন্ন সময় এই বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলেজের রুম ও সিট বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি তিলোত্তমা শিকদার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশিকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে কলেজ ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা বলেন, আমি যদি ভুল করি, তাহলে সংগঠন আমার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। অন্য কেউ ভুল করলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আমি সংগঠনের সব সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ইডেন কলেজের কমিটি হওয়ার পর তাদের মধ্যে ঝামেলা দেখা দিলে কমিটির নেতৃবৃন্দ ও তাদের দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আমরা পার্টি অফিসে বসেছিলাম। তাদের নানা ধরনের নির্দেশনাও দিয়েছিলাম। এর পরও অনেকে কেন্দ্রের নির্দেশ না মেনে এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর