ভাই বড় না বউ বড়?

এইচ এম এরশাদ একসময় বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মানে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মানে সিএমএলএ ছিলেন। কিন্তু এরশাদ আসলে চিরকালীন সিএমএলএ। এই সিএমএলএ মানে ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। রাজনীতির ক্যারিয়ারজুড়ে এরশাদ সকাল বিকাল সিদ্ধান্ত বদলানোর ব্যাপারে ওস্তাদ। ইদানীং অবশ্য তার একজন অনুসারী মিলেছে। ডাকসুর নবনির্বাচিত নুরুল হক নূর। তিনিও সিদ্ধান্তহীনতায় এরশাদের কাছাকাছি। এরশাদ যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন অতোটা টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি আসল সিএমএলও। হুটহাট কলমের খোঁচায় কাউকে ক্ষমতাশালী করেন, কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ যা করেছেন, তা তো সিদ্ধান্তহীনতার ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগেও এরশাদ কম নাটক করেননি। দিনের পর দিন দেশে-বিদেশে হাসপাতালে কাটিয়েছেন। কিন্তু হামপাতালে বসেই কলকাঠি নেড়েছেন। নির্বাচনের আগে আগে হুট করে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মসিউর রহমান রাঙাকে মহাসচিব করেন। পাঁচদিন পর আবার রুহুল আমিন হাওলাদারকে চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী হিসেবে দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঘোষণা করা হয়। যদিও রুহুল আমিন হাওলাদার সে দায়িত্ব পালন করেননি।

অনেকদিন ধরেই জাতীয় পার্টিতে দুটি ধারা। একটির নেতৃত্বে এরশাদ নিজে, আরেকটির নেতৃত্বে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। ২০১৪ সালে এরশাদ নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন, রওশন ছিলেন পক্ষে। এরশাদকে সিএমএইচে রেখে রওশনপন্থিরা নির্বাচনে যায়। রওশন হন বিরোধী দলীয় নেতা। এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। আর এরশাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সে নির্বাচনেই অংশ নেননি এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান বানানো হয়। কিন্তু বেঁকে বসে দলের রওশনপন্থিরা। পরে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেন এরশাদ।

৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর অসুস্থ এরশাদ ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলে তার উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। নিজে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হলেও উপনেতা বানান জিএম কাদেরকে। এবার রওশনপন্থিরা কোণঠাসা হয়ে যান। রওশান এরশাদকে কোথাও দেখা যায়নি অনেকদিন। আবার বাধিল গোল। ২০ মার্চ ছোট ভাইকে পাশে বসিয়ে ৯০তম জন্মদিন পালন করার একদিনের মধ্যেই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ২২ মার্চ এক সাংগঠনিক আদেশে এরশাদ বলেন, ‘আমি ইতোপূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলাম যে আমার অবর্তমানে পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের পার্টির পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন এবং আমি এটাও আশা প্রকাশ করেছিলাম যে পার্টির পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিল তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে। কিন্তু পার্টির বর্তমান সার্বিক অবস্থার বিবেচনায় আমার ইতোপূর্বেকার সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিলাম’। পরদিন আরেক আদেশে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার পদ থেকেও জিএম কাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন উপনেতা হয়েছেন রওশন এরশাদ। দশম সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, একাদশ সংসদে হয়ে গেলেন বিরোধীদলীয় উপনেতা। প্রমোশন না ডিমোশন? এরশাদের এই কা-কারখানা দেখে আমার সম্ভাব্য একটি সিনেমার নাম মাথায় এসেছে, ভাই বড় না বউ বড়? ছেলেবেলায় আরেকটি কথা শুনেছিলাম, ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাধন; যদিও পৃথক হয়, নারীরই কারণ’। এখানে কারণটা অবশ্য এখনও জানা যাচ্ছে না।

এরশাদের এই হুটহাট সাংগঠনিক আদেশে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা উল্লেখ করা থাকে। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র এই মুহূর্তে হাতের কাছে নেই। তাতে কী লেখা আছে জানি না। নিশ্চয়ই লেখা আছে, চেয়ারম্যান যখন খুশি, যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। আরেকটা কথা, জিএম কাদেরের অপসারণে প্রমাণিত হলো, জাতীয় পার্টিতে ভদ্রলোকের কোনো ঠাঁই নেই।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর