গ্রাহকের টাকায় কানাডায় রিং আইডির মালিক দম্পতির বিলাসী জীবন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে তৈরি করা রিং আইডি নামের একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লাইভ স্ট্রিমিং, বিজ্ঞাপন দেখানোসহ বিভিন্নভাবে অর্থ আয়ের লোভনীয় অফার দিয়ে ফাঁদে ফেলতো কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষরা। এর অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষকে অর্থের বিনিময়ে সিলভার আইডি ও গোল্ড আইডি খোলায় উদ্বুদ্ধ করা হতো। কমিশন হিসেবে বিপুল অর্থ আয়ের অফার দিয়ে গ্রাহকের টাকা নিয়ে কানাডায় আলিশান জীবনযাপন করছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দম্পতি। রিং আইডি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফুল ইসলাম এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম।

সম্প্রতি এই দম্পতিসহ তিন জনের নাম উল্লেখসহ রিং আইডি বিডি লিমিটেড ও রিং আইডি ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে গুলশান থানায় মামলা করেছে সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টার।

সূত্র জানিয়েছে, রিং আইডির বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে ৩৭ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। এরপরই শরীফুল ও আইরিন দম্পতি এবং শরীফুলের ভাই সাইফুলকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। এরপর তদন্তের মাধ্যমে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে আদালতে চার্জশিট জমা পড়বে।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি ই-কমার্স ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে। তখন একযোগে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও আইনি ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। এরপর গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ভাটারা থানায় রিং আইডির মালিক দম্পতিসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিং আইডি’র মালিক শরীফুল ইসলামের ভাই সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।

মামলাটির তদন্তের অংশ হিসেবে রিং আইডি’র বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গত ৪ আগস্ট গুলশান থানায় অর্থপাচার আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর এজাহারে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে রিং আইডি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রিং আইডি বিডি লিমিটেড ২০১৫ সালে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতর থেকে নিবন্ধন নেয়। এছাড়া রিং আইডি ডিস্ট্রিবিশন লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠা ২০২১ সালের ৩০ জুন নিবন্ধন নিয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একই ব্যক্তি।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিআইডির অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুটি প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পেয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাবে ৩৭৭ কোটি জমা হয়। একই সময়ের মধ্যে ৩০২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।

সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা পাঁচটি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে ৩৭ কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাতের তথ্য পেয়েছেন। অন্যদিকে কয়েকটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির মাধ্যমে ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যেসব অর্থ আয় করেছে রিং আইডি সেসব টাকা বাংলাদেশে আনার কথা থাকলেও বিদেশে পাচার হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, রিং আইডি’র স্বত্বাধিকারী শরীফুল ইসলাম কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি ভিশন টেল ও ক্লাউড টেল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (বিটিআরসি) সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। বিটিআরসি’র কাছ থেকে ২৯৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। এর অংশ হিসেবে শরীফুল-আরিন দম্পতিকে একবার গ্রেফতার করেছিল সিআইডি। কিন্তু একমাসের মাথায় জেল থেকে জামিন নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমান তারা। এরপর কানাডায় বসেই রিং আইডি বিডি লিমিটেড এবং রিং আইডি ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড চালু করেন তারা। ঢাকার নিকেতনর এলাকায় একটি অফিস নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান দুটির দেখভাল করতেন শরীফুলের ভাই সাইফুল ইসলাম।

সূত্র জানায়, রিং আইডি মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচয় দিয়ে অবৈধভাবে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) কাজ করতো। তারা ২২ হাজার টাকার বিনিময়ে গ্রাহকদের সিলভার আইডি ও ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে গোল্ড আইডি খোলার অফার দিতো। এসব আইডির মালিকরা সাধারণ গ্রাহকদের রিং আইডিতে যুক্ত করে ভিডিও স্ট্রিমিং ও বিজ্ঞাপন দেখার অফার দিতো। সেই বিজ্ঞাপনের ভিউ থেকে আয়কৃত অর্থের একটি অংশ এজেন্ট হিসেবে সিলভার বা গোল্ড আইডির মালিক, একটি অংশ ভিউয়ার্স ও বড় একটি অংশ রিং আইডি কর্তৃপক্ষ নিতো। প্রথম দিকে গোল্ড বা সিলভার আইডি হোল্ডারদের কিছু অর্থ দেওয়া হলেও বেশিরভাগ অর্থ হাতিয়ে নেয় রিং আইডি কর্তৃপক্ষ।

সিআইডি’র একজন কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, দেশ থেকে অবৈধভাবে আয়কৃত অর্থ বিভিন্ন কৌশলে কানাডায় নিয়ে রিং আইডি’র মালিক শরীফুল-আইরিন দম্পতির বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে কানাডার মন্ট্রিয়েলে বাস করেন তারা। অর্থপাচার আইনে মামলা হওয়ার পর বিস্তারিত তদন্ত কাজ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ইন্টারপোলের মাধ্যমে শরীফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চিঠি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর