চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে উধাও এনজিও মালিক

ভিক্ষাবৃত্তি ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন নির্বাহ করেন মোসা. হেনা বেগম (৬২)। আপনজন বলতে দুনিয়ায় তার কেউই নেই। এখন স্বাভাবিকভাবে একা একা চলাফেরা করতে পারেন হেনা বেগম। তিনি জানেন, অসুস্থ হলে কিংবা কোন বিপদ-আপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই ৷ তাই একা জীবনে যা উর্পাজন করেন, তা ভবিষ্যৎ জীবনের সংকটময় সময়ের জন্য জমা করেন দীর্ঘদিন ধরে।

হেনা বেগম প্রায় এক দশক ধরে অন্যের বাড়িতে কাজ ও ভিক্ষা করেই জমিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। তার এই টাকা জমানোর খবর জানতে পেরে স্থানীয় একটি অবৈধ এনজিও’র মাঠকর্মী বারবার অনুরোধ করে টাকা জমা রাখতে। যেকোন সময় ইচ্ছে হলেই টাকা তুলতে পারবে, এমন শর্তে নিজের পুরো টাকা হেনা বেগম জমা রাখেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের মেঘুবাজারের অবৈধ এনজিও কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে।

কানসাট ইউনিয়নের বালুচর গ্রামের দিনমজুর হারুন আলী কৃষি কাজ ও ভ্যান চালিয়ে জমানো ৪০ হাজার টাকা সঞ্চয় রেখেছেন কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে। একই গ্রামের আরমানের স্ত্রী রানী বেগম জমি বিক্রির ৪ লাখ টালা জমা রেখেছেন ২ বছর আগে। হেনা, হারুন, রানীদের মতো কয়েকশ গ্রাহক নিজেদের জমানো টাকা সঞ্চয় করেছেন এই এনজিওতে। তবে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ জমা রাখতে গিয়ে তারা সকলেই এখন অসহায়ত্বের মধ্যে দিন পার করছেন।

গত কয়েকমাস থেকে ঘুরে ঘুরেও গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিচ্ছে না কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। কয়েকদিন আগে শিবগঞ্জের কানসাট ও মোবারকপুর ইউনিয়নের কয়েকশ গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের মালিক কানসাট ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে ডলার আলী।

মালিক পালানোর প্রায় ৪ মাস আগে থেকে কানসাট ইউনিয়নের মেঘুবাজারের সুকুদ্দির বাড়িতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে আসেন না মাঠকর্মীরা। বর্তমানে তালা দেয়া রয়েছে কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের অফিসে। জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে সমাজসেবার নিবন্ধন নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা।

গ্রাহক হেনা বেগম বলেন, অনেক কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে চেয়ে চেয়ে ও কাজ করে টাকাগুলো জমিয়েছি। এখবর পেয়ে মাঠকর্মী সুমি বাড়িতে এসে টাকাগুলো এনজিওতে রাখার জন্য বলে। কয়েকবার ঘুরে ঘুরে টাকাগুলো তার এনজিওতে রাখি। কিন্তু এখন দরকারের সময় টাকা দিতে নানারকম টালবাহানা করছে। অফিস বন্ধ করে মালিক পালিয়েছে। এনজিও মালিক ডলারের বাড়িতে গেলে তার পরিবারের লোকজন উল্টো আমাদেরকেই নানারকম হুমকি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে ও র্দুব্যবহার করছে।

রানী বেগম (৩৮) জানান, বাবার বাড়ি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু জমি বিক্রি করে পাওয়া ৪ লাখ টাকা জমা করেছিলাম গত ২ বছর আগে। গত ৬ মাস থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য ঘুরছি। আজকাল পরশু বলে বারবার ঘুরিয়ে পাঠায়। এমনকি এনজিও মালিক ডলারের বাড়িতে গেলে উল্টো আমাদেরকে পুলিশের ভয় দেখায়। এখন আমরা কি করব, কোথায় যাব? আমার জীবনের সব শেষ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টের জমানো টাকা হারিয়ে আমার স্বামী দিশেহারা হয়ে গেছে।

বাড়িতে গরু-ছাগল পালন করেন স্বামী পরিত্যক্তা গেদিয়ারা বেগম। তিনি বলেন, বাড়িতে গরু-ছাগল পালন করে তা বিক্রি করে ও জমানো কিছু মিলে কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে মোট ৬০ হাজার টাকা সঞ্চয় রেখেছিলাম। মাঠকর্মী সুমি ও মালিক ডলারের বাড়িতে একাধিকবার গেলেও তারা কোন পাত্তা দেয়নি। কয়েকদিন আগে এনজিও মালিক পালিয়ে গেছে।

কানসাট ইউনিয়নের রাঘুপুর গ্রামের আনারুলের স্ত্রী উজালা বেগম জানান, আমের বাগান বিক্রির আড়াই লাখ টাকা রেখেছিলাম এই এনজিও তে। এরপর এখন নিজের দরকারের সময়ে গত ৬ মাস থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য ঘুরছি। একটা টাকাও দেয় না। একই গ্রামের সাহিদা বেগম গত দুই বছর আগে গরু বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা জমা রেখেছেন। তিনি টাকা পাবার আশায় বারবার ঘুরছেন এনজিওর প্রধান কার্যালয় ও মালিকের বাড়িতে। তবে টাকা তে দূরের কথা কারো দেখায় পাচ্ছেন না তিনি।

মেঘুবাজার এলাকায় কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় রয়েছে মো. সুকুদ্দির বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে ২০১৮ সাল থেকে অফিস আছে। তার আগে অন্য জায়গায় ছিল বলে শুনেছি। গত ৫ মাস আগে থেকে অফিসে মাঝেমধ্যে একজন মাঠকর্মীকে আসতে দেখি। আর বাকিরা অফিসে আসেন না ও তালা মারায় থাকে।

এবিষয়ে কথা বলতে কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের মালিক ডলার আলীর বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। ক্যামেরার সামনে কথা বলতো চান না ডলার আলীর মা ও স্ত্রী। তারা জানান, ডলার আলী অসুস্থ, সিরাজগঞ্জে তার চিকিৎসা চলছে। ডলার আলীর একটি ফোন নাম্বার দিলেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে, মাঠকর্মী সুমি খাতুনকেও তার বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

কানসাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেফাউল মূলক বলেন, আমার কয়েকজন গ্রাহক একাধিকবার এবিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে এনজিও মালিক ডলারের সাথে কিছুদিন আগে আমার কথা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, সকলের পাওনা টাকা পরিশোধ করে দিবেন। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সমাজসেবা কর্মকর্তা ফিরোজ কবীর জানান, সমাজসেবার নিবন্ধন দেয়া হয় শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবীমূলক সামাজিক কার্যক্রম করার জন্য। এই নিবন্ধন নিয়ে কোনপ্রকার আর্থিক লেনদেন করার সুযোগ নেই। কোন গ্রাহক যদি তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ দেন, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তবে এই মূহুর্তে নিবন্ধন বাতিল করা জনগণের জন্যেও খুব একটা ভালো হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল হায়াত মুঠোফোনে বলেন, কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোন গ্রাহক প্রতারণা বা এমন হয়রানির অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তারেক/বার্তাবাজার/এম.এম

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর