জানা গেল জিতুর বেপরোয়া হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য

জিতু, সম্পূর্ণ নাম আশরাফুল ইসলাম জিতু। গত মাসের ২৫ শে জুন নিজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে আহত করে সে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতের দুই দিন পর ২৭ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার।

আশুলিয়ায় হাজী ইউনূস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার এবং একই কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল জিতু।

প্রভাবশালী পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া স্বভাবের ছিল জিতু। শিক্ষক উৎপল হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি হয়ে এখন পুলিশ হেফাজতে সে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার পরিবার। সর্বশেষ পরিচালনা পর্ষদেও পরিবারের চারজন সদস্য জড়িত ছিলেন। জিতুদের বাড়ি জামগড়া এলাকার চিত্রাশাইলে।

সরজমিনে দেখা যায়, সর্বত্র আলোচনা জিতুকে নিয়ে। জিতুর বাল্যবন্ধু মো. মাসুদ। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা ক্রিকেট খেলতাম। জিতুর ব্যাট-বল ছিল। অনেক সময় ব্যাটিং করে চলে যেত বোলিং করতো না। এজন্য অন্যরা আমাদের সঙ্গে না খেলে অন্য মাঠে যেত। তখন সম্ভবত আমরা ফোর বা ফাইভে পড়তাম।

খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তখনই আশিক নামে এক ছেলের গায়ে হাত তোলে জিতু। এই ঘটনার পর আশিকরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই অন্যরা ভয় করতো জিতুকে। জিতুর বাড়ির পাশেই মসজিদ। এখানকার মুসল্লিরা বলেন, জুমার নামাজ পড়তে মাঝেমধ্যে আসতো জিতু। অন্যান্য সময় দেখা মিলতো না।

ষাটোর্ধ্ব জহিরুল ইসলাম বলেন, এলাকার পোলাপাইন নিয়া চলতো। মসজিদে খুব একটা দেখা না গেলেও শবে মিরাজ, শবে বরাত ও শবে কদরের রাতে সারারাত আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়াত। রাতগুলোতে বিভিন্ন দোকানের লাইট ঢিল মেরে ভাঙতো। জিতু দশম শ্রেণিতে পড়লেও তার রয়েছে স্টাডি গ্যাপ। নবম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হয় এই স্কুলে। জিতু উত্তরার একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতো। কিন্তু তার অধিকাংশ সময় কাটতো এলাকাতেই। ঠিকমতো যেত না মাদ্রাসায়। জিতু কয়েক বছর আগে থেকেই চলাচল করতো মোটরসাইকেলে। এলাকায় চলাচল করতো উচ্চ গতিতে। জিতুর গ্যাং পরিচিত ছিল ‘জিতু দাদা গ্যাং’ নামে। জিতু নামটা শোনার পর অনেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাবতো। যার ফলে তাকে দাদা নামে সম্বোধন করতো। গ্যাংয়ে সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ থেকে ১৮ জন।

যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। তাদের একজন এটাকে গ্যাং মানতে নারাজ। তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে চলাচল করি। ক্রিকেট খেলি, আড্ডা দেই। জিতু যেটা করেছে সেটা মোটেও ঠিক করেনি। স্যারের প্রতি জিতুর রাগের কথা আমরা জানতাম। রাগের মাথায় বলেও ছিল স্যারকে মারবে কিন্তু বিষয়টা খুব একটা সিরিয়াসলি নেইনি। স্কুলের মাঠের একপাশে মুক্তমঞ্চ ও ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন উৎপল স্যার। সেখানেই হামলা করে জিতু। তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন জিতু স্ট্যাম্প নিয়ে স্কুলে আসে। স্ট্যাম্প লুকিয়ে রেখেছিল মুক্তমঞ্চের পাশে। আমরা দোতলা থেকে খেলা দেখছিলাম এমন সময় চোখের সামনে এই ঘটনা দেখি। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘জিতু দাদা’ গ্রুপ এলাকায় মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতো। এলাকায় ‘গ্যাঞ্জাম’ লাগলে ছুটে যেত সেখানে। বিস্তার করতো প্রভাব। বিকালের পরে তাদের আড্ডা বসতো ‘ফ্যান্টাসি কিংডম’র সামনে। এই সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতো তারা। কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফিদ চৌধুরী বলেন, স্কুল বা কলেজের অনেকের মাঝেই ‘রিলেশন’ আছে।

কিন্তু জিতু ও তার বান্ধবী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতো। কলেজের মাঝেও ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। স্যাররা বিষয়টাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলতেন। মোটরসাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতো এলাকায়। এক ছাত্রী বলেন, জিতুর ‘রিলেশন’ থাকলেও অন্যান্য মেয়েদেরকেও উত্ত্যক্ত করতো। আমার পিছনে বছরখানেক ঘুরেছে। অনলাইন, অফলাইনে প্রপোজ করেছে। গত বছর টিউশন থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির কারণে কলেজের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। জিতু আমাদের সামনে আসে এবং পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে দিয়ে যায়। এরপর নানা কথা বলতে থাকে। জিতুর বোনও একই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওর বোনকে একটা ছেলে ‘প্রপোজ’ করেছিল। সেই ছেলেকে স্কুলের মাঠে নিয়ে পেটায় জিতু। কিন্তু নিজে ঠিকই মেয়েদের উত্ত্যক্তের মতো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল। জিতুর বিপক্ষে উৎপলের নানা অভিযোগের মধ্যে একটি ছিল চুল বড় রাখা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, জিতু বড় চুল রাখায় অন্য শিক্ষার্থীদের শাসন করতে পারতেন না শিক্ষকরা।

বিশেষ করে জিতুর ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বলতে পারতেন না কিছুই। জিতুর বাড়ির পাশেই একটি সেলুন। এই সেলুনে কাজ করছিলেন ধর্মেন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ও এসে বলতো লেয়ার কাট দিতে। সামনের চুল কাটতে দিতো না। এলাকা থেকে শুরু করে স্কুল- সর্বত্র ছিল জিতুর একচ্ছত্র আধিপত্য।

স্থানীয় হওয়ার পাশাপাশি অভিযোগ মেলে জিতু চাচার ক্ষমতায় চলতো। তার চাচার নাম মাহরুফ আলী সুমন। তিনি স্থগিত হওয়া পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়াও তার পরিবারের চারজন সদস্য এই কমিটিতে ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠাও হয়েছে জিতুর পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই।

এক শিক্ষিকা বলেন, ঘটনার পূর্বে নানা অভিযোগ জানানো হয়েছিল জিতুর বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এমনকি সাধারণ যে অভিযোগ চুল বড় রাখা ও ইউনিফরম পরে না আসা এগুলোও বন্ধ হয়নি। তার বাবার কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তিনি আরও বলেন, ওই ছাত্রীর সঙ্গে ‘অন্তরঙ্গ’ অবস্থায় ক্যাম্পাসে দেখার পর উৎপল স্যার দুই পরিবারকেই প্রতিষ্ঠানে ডেকে পাঠান। এতেই বিপদ আসন্ন হয় স্যারের। আর স্কুলের বাইরে আমাদের সামনে প্রকাশ্যে ধূমপান করতো। আমরাই চোখ সরাতাম। এক কথায় বলা যায়- তার ছিল নৈতিক শিক্ষার অভাব।

বার্তাবাজার/এ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর