বন্যায় দিশাহারা মানুষ, হারিয়েছে পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট

সর্বনাশা বন্যা নিমিষেই নিঃস্ব করে দিয়েছে অনেককে। ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়েছে। ভেসে গেছে ধানের গোলা। জাতীয় পরিচয়পত্র, স্কুলের বই, পাসপোর্ট, বাড়ির দলিলসহ মূল্যবান সম্পদ টাকা, স্বর্ণসহ মূল্যবান জিনিস রক্ষা করতে পারেননি অনেকে। এসব হারিয়ে এখন দিশাহারা সিলেট-সুনামগঞ্জের লাখো মানুষ। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার কানারুখা ইউনিয়নের বাসিন্দা রুপিয়া বেগম। চার সন্তানের এই জননীর ঘরে জাতীয় পরিচয়পত্রধারী সদস্য ৮ জন। বন্যায় রুপিয়াদের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রাতের বেলা হঠাৎ পানি বাড়ায় পরিবারের সদস্যরা এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিলেন। বানের পানিতে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের সঙ্গে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রও ভেসে গেছে।

পরিবারের আটজনের কারো পরিচয়পত্র উদ্ধার করতে পারেননি। রুপিয়া বলেন, ছেলেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথাবার্তা পাকা করেছিলাম। ভেবেছিলাম কিছুদিনের ভেতরে পাসপোর্ট করতে দিবো। কিন্তু এখন জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় ঝামেলা পোহাতে হবে। শুনেছি নতুনভাবে বের করতে হলে বেশ ঝক্কিঝামেলা।

এছাড়া আমরা লেখাপড়া জানি না। সবকিছু আমাদের জন্য একটু কঠিন হবে। কোথায় যাবো কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। ছাতকের উজিরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। নদীর কাছের একটি বাড়িতে রবিদাস সম্প্রদায়ের ৮টি পরিবারের বসবাস। নদীর তীরে বাড়ি হওয়াতে বন্যার প্রথমদিকে এই বাড়ির সবক’টি ঘর ভেঙে গেছে। এসব ঘরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০ জনের বসবাস। তারমধ্যে ২০ জন জাতীয় পরিচয়পত্রধারী। বন্যার পানিতে তাদের শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নষ্ট হয়নি। বাড়ির দলিল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া স্কুলপড়ুয়া ২০ জন শিক্ষার্থীর বই, খাতা। বাড়ির বড়কর্তা দুলাল রবিদাস আক্ষেপ করে বলেন, কয়েকটা হাঁড়ি পাতিল ছাড়া আর কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি। প্রাইমারি ও হাইস্কুলে পড়ে বাড়ির ছোটরা। ১টা বইও উদ্ধার করা যায়নি। আর ২০টির মতো জাতীয় পরিচয় পত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পানি বিপদসীমায় আসার কারণে আমরা সবাই নিজের প্রাণ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। পানিতে ভাসতে ভাসতে কোথাও ঠাঁই মিলছিল না। এলাকার প্রাইমারি স্কুলে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে জোরাজুরি করে নিজেরা প্রাণ বাঁচাতে তালা ভেঙে স্কুলে ঢুকেছি। তিনি বলেন, বন্যার পানি কমছে।

এখন পরিবারের অনেকের ডায়রিয়া, জ্বর-সর্দিসহ নানা রোগ-বালাই দেখা দিয়েছে। জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সরকারি ওষুধ দিতে চায় না। ছাতকের রুপিয়া বেগম আর দুলাল রবিদাস নন। সিলেটে-সুনামগঞ্জে বন্যায় লাখ লাখ মানুষের স্বর্ণ, টাকা, জাতীয় পরিচয় পত্র, বাড়ির দলিল, পাসপোর্ট ভেসে গেছে। ভেসে গেছে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীদের বই। জাতীয় পরিচয় পত্র নষ্ট হওয়াতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে পারছেন না। যাদের পাসপোর্ট পানিতে নষ্ট ও ভেসে গেছে তারাও সাময়িক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। কারণ অনেকেই সদ্য বিদেশ থেকে ছুটিতে এসেছেন। খুইয়েছেন পাসপোর্ট। পাসপোর্ট ছাড়া ফেরত যেতে পারবেন না। পাসপোর্টের সঙ্গে ভিসা ছিল। এখন নতুন করে সবকিছু ঠিক করতে হবে।

যা সময় সাপেক্ষ। মূল্যবান এসব জিনিস হারিয়ে মানুষ এখন দিশাহারা। দুই সপ্তাহ পানিবন্দি থাকার পর অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ এসব জিনিস ঘরে গিয়ে খুঁজে পাচ্ছেন না। ধারণা করছেন বানের জলে ভেসে গেছে সব। সিলেটের ওসমানীনগর থানার সাদীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেদ আহমেদ বলেন, বন্যার পানিতে আমার এলাকার অনেক মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, বাড়ির দলিল, শিক্ষার্থীদের বই ভেসে গেছে। এজন্য অনেকেই আমার কাছে এসেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্য সংগ্রহ করছি।

তাদেরকে সহযোগিতা করবো। সুনামগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুরাদ উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ভুক্তভোগীরা আবেদন করলেও যত দ্রুত সম্ভব যদি দিনের ভেতরে হয় আমরা দেওয়ার চেষ্টা করবো। সিলেট জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শুকুর মাহমুদ মিঞা মানবজমিনকে বলেন, ভুক্তভোগীরা থানায় জিডি করে অনলাইনে আবেদন করবে। আর ফি জমা দিতে হবে ২৩০ টাকা। তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পরিচয় পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

এক্ষেত্রে কাউকে কোনো হয়রানির শিকার হতে হবে না। বন্যার পানিতে বই নষ্ট হওয়াতে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। পানিবন্দি থাকায় এলাকার প্রাইমারি ও হাইস্কুলগুলো এখনও আশ্রয়কেন্দ্র। তবে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বন্যাদুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন।

সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আমরা মাঠপর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করছি। কোন কোন এলাকার শিক্ষার্থীদের বই নষ্ট হয়েছে। ইতিমধ্যে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকি উপজেলারও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দিচ্ছেন। আমাদের কাছে তথ্য আসার পর যাদের বই নষ্ট হয়েছে তাদের বইয়ের ব্যবস্থা করে দেবো।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আমরা বইয়ের ব্যবস্থা করবো। কতজন শিক্ষার্থীর কী পরিমাণ বই লাগবে সেই তথ্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে বের করা হচ্ছে। যত বই লাগুক সেটির ব্যবস্থা করা হবে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের আব্দুর রহমান বলেন, আমার ঘরে ৬ ফুট পানি ছিল। ঘরে যা আসবাবপত্র ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। ভেসে গেছে আরও অনেক কাগজপত্র। তবে পাসপোর্ট হারিয়ে আমি বিপদে পড়েছি। কারণ জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমার দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। ভিসাও লাগানো ছিল। এখন আবার পাসপোর্টের আবেদন করতে হবে। দোয়ারাবাজারের দোয়ালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, সৌদি আরব থেকে ১ মাস আগে বাড়ি এসেছি। আকস্মিক এই বন্যায় আমার বাড়ি-ঘরের অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে। ঘরে বুক সমান পানি ছিল।

পাশের প্রাইমারি স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলাম। পানি কিছুটা কমার পর বাড়ি এসে দেখি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুর সঙ্গে আমার পাসপোর্টের ব্যাগ খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জুলাই মাসের শেষের দিকে আমার সৌদি যাওয়ার কথা। রিটার্ন টিকেটও করে এনেছিলাম। এখন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়লাম কিছু ভেবে পাচ্ছি না।

সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, বন্যার কারণে আমাদেরও এক সপ্তাহ অফিস বন্ধ ছিল। এখনও কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। ঢাকা থেকে লোক এলে রোববার থেকে কার্যক্রম শুরু করবো। আর বন্যায় যাদের পাসপোর্টের পাতা ভিজে গেছে, ডেলিভারি স্ল্লিপ পাওয়া যাচ্ছে না তারা আমার কাছে আসলে আমি ইন্টারভিউ নিয়ে পাসপোর্ট ডেলিভারি দিয়ে দিবো। এছাড়াও আমরা পাসপোর্টধারী ও পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সব ধরনের সহযোগিতা করবো।-মানবজমিন

বার্তাবাজার/এ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর