দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা নিয়ে বাড়ি ফিরছে বনভাসিরা

প্রাকৃতিক দূর্যোগ বন্যায় লণ্ডভণ্ড দেশের উত্তরের জেলা সিলেট ও সুনামগঞ্জ। হঠাৎ করেই উজানের ঢলে ভেসে গেছে ঐজেলাগুলো। এক কাপড়ে অনেকেই বাড়ি ছেড়েছিলেন। কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন উচুঁ স্থানে। পরে পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী তাদের নিরাপদে নিয়ে এসেছে। প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস। অনাহারে, অর্ধাহারে দিন যাপন করেছেন। এখন পানি নামছে। বাড়িঘর ভেসে উঠছে। কিন্তু সব রেখে চলে আসা মানুষগুলো বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

কারো ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কারো ঘর থাকলেও ভেতরে আসবাবপত্র পানিতে ভেসে গেছে। গবাদিপশু কিছুই নেই। মাঠের বা ঘরের ধানও নেই। কী করবেন এখন? এমন বাস্তবতায় দিশাহারা সিলেটের বানভাসি কয়েক হাজার মানুষ। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ কমতে শুরু করায় অনেকেই চলে যাচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। উজানের ঢলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা।

এছাড়া শেষের ঢলে জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগরের মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছেন। এর সংখ্যা হাজার হাজার হবে বলে জানিয়েছেন বন্যাদুর্গত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। অনেক এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গোয়াইনঘাটের আসামপাড়া গ্রামের জুলহাসের ঢলে নদীতে তলিয়ে গেছে ঘর। এখন বসবাস করছেন অন্যের বাড়ি। জানালেন, ‘ঢল আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে নিরাপদে চলে এসেছিলেন। ফিরতে পারেননি। এরপর ঢল তলিয়ে নিয়েছে বাড়ি। এখন কোনো চিহ্নও নেই বাড়ির। পার্শ্ববর্তীতে বাড়িতে এখন আশ্রিতা তিনি।’

বাউরভাগ গ্রামের জব্বার, সিরাজ, বাবর আলী, ইমাম, ছাত্তারসহ কয়েকজনের বাড়িও পানির তোড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ১৬ই জুন ঢল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাড়ি ছেড়েছিলেন। এক সপ্তাহ ছিলেন স্বজনদের বাড়িতে আশ্রিত। বাড়ি ফিরেছেন দু’দিন হলো। কিন্তু ঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আসবাবপত্র সব পানিতে ভেসে গেছে। গবাদিপশুও নেই। এমন দুুুর্দিন তাদের জীবনে কখনো আসেনি। আব্দুল জব্বার জানালেন- ‘প্রবল বেগে আসা ঢলে বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ঘরের খাট, ফার্নিচার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অবশিষ্ট বলতে আর কিছু নেই। এখন তারা গ্রামের মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

নতুন করে ঘর বানানোর মতো সামর্থ্য নেই তাদের।’ কোম্পানীগঞ্জর উত্তর রাজনগর গ্রামের শফিক মিয়া জানালেন, ‘প্রথম দিন যখন ঢল নামে তখন পরিবারকে নিয়ে কোনো মতে ঠাঁই নিয়েছিলেন নিরাপদ স্থানে। এরপর বাড়িঘরের খবর রাখতে পারেননি। তিনদিন আগে বাড়ি ফিরে দেখেন সব ভেসে গেছে। ঘর বিধ্বস্ত অবস্থায় ভিটায় পড়ে রয়েছে। পরিবার নিয়ে এখন বাড়ির উঠোনে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন বলে জানান তিনি।’

একই বাড়ির মঙ্গলের অবস্থাও একই। তাঁবু টাঙিয়ে বসবাস করছেন উঠোনে। গ্রামের লোকজন তাদের খাবার দিচ্ছেন। রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। দুর্গম চানপুর গ্রামের আমিনা বেগম। ঢল হওয়ার পর প্রতিবন্ধী তিন সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। গ্রামের লোকজন তাদের নৌকা নিয়ে উদ্ধার করে থানা সদরের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এখনো তিনি সেখানে রয়েছেন। আমিনা বেগম জানিয়েছেন- ‘অবস্থা দেখতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঘর তো নেই। ভেঙে পড়ে আছে। ঘরে যা ছিল পানিতে ভাসিয়ে নিয়েছে। আমেনা বেগমের প্রশ্ন; এখন যাবো কোথায়? আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো রয়েছি। কোনো ব্যবস্থা হলে তবেই বাড়ি ফিরবো।’

একই এলাকার শিলরভাঙা গ্রামের আব্দুল মজিদের ঘর ভেঙে গেছে। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন স্বজনদের বাড়িতে। আব্দুল মজিদ জানিয়েছেন, ‘ঘুমের মধ্যে ঘরের ভেতরে দেখলাম কোমর পানি। পরিবার নিয়ে কোনো মতে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠি। এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরে দেখি ঘর নেই। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

গোয়ালে কয়েকটি ছাগল ছিল। সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। জৈন্তাপুরের সারি নদীর তীরে বড়খেল গ্রামের আবুল কাশেমের বাড়ি। ঢল নামার প্রথম দিনই ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার গোটা বাড়ি। এই ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দুই সপ্তাহ ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন অন্যের বাড়িতে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ‘আমাদের আর ফেরার কোনো জায়গা নেই। ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে ঢলে। ঘরে থাকা সব জিনিসপত্রও ভেসে গেছে। কোনো মতে আমরা প্রাণে রক্ষা পাই। জমি থাকলে ঘর বানানো যেত। যেহেতু জমি নেই, যাওয়ার জায়গাও নেই।’

জৈন্তাপুরের উত্তর কানজর গ্রামের নুরউদ্দিন বলেন, ‘বন্যার পানি বাড়িতে উঠে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে যান। এরপর আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন। এখন বাড়ি ফিরে দেখেন বসতঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। থাকার মতো জায়গা নেই।

এখন গ্রামে অন্যের বাড়িতে বসবাস করছেন। তার গ্রামে আরও কয়েকজন মানুষ এভাবে ঘরহীন অবস্থায় বসবাস করছেন জানান নুরউদ্দিন।’ কানজর গ্রামের হাসান আহমদও বাড়ি হারিয়েছেন। জানালেন- ‘এমনভাবে ঢল নেমেছিল, মনে হয়েছিল সব ভাসিয়ে নেবে। নিয়েছেও। বাড়ি ফিরে দেখি ঘর ভেঙে পড়ে আছে। ঘরের আসবাসপত্র নেই। রান্না করার সুযোগ নেই।’ এদিকে বানভাসি মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সিলেটের প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্যরা ত্রাণ কার্যক্রমে রয়েছে। পাশাপাশি বিধ্বস্ত হওয়া সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক করতে কাজ করছেন সেনা সদস্যরাও। প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রথম দিকে তারা উদ্ধার কাজ, পরে আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না করা খাবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখন দুর্গম এলাকাগুলোতে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করেছেন। একই সঙ্গে চলছে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নিরূপণও। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে- সিলেট জেলার সিটি করপোরেশন আংশিক ও ১৩টি উপজেলার ৯৯টি ইউনিয়নই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

প্রায় ৩০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতি হয়েছে। এরই মধ্যে প্রশাসনের তরফ থেকে প্রায় ১৭০০ টন চাল ও নগদ দুই কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বানভাসি মানুষকে ঘরে ফেরানো। সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- ‘সিলেটে বন্যায় যেসব মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের প্রকৃত তালিকা প্রস্তুতে কাজ চলছে। ইতিমধ্যে উপজেলাগুলোতে তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আজকালের মধ্যে সেই তালিকাও আসবে। এরপর সেটি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হবে।’

তিনি জানান- ‘আমরা আশা করি পুর্নবাসনের কাজটিও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু করতে পারবো। প্রধানমন্ত্রী সিলেটের বন্যার সার্বিক বিষয়টি দেখভাল করছেন। আমরা যখন যা আব্দার করছি, সবই পাচ্ছি।’ কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও লুসিকান্ত হাজং জানিয়েছেন- ‘জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করছি। পুনর্বাসনের জন্য প্রকৃত ব্যক্তিদের তালিকা করা হচ্ছে। সেটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

খুলছে স্থলবন্দর: করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা ভারতের সঙ্গে ১১টি চেকপোস্টে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম পুনরায় চালুর অনুমতি দিয়েছে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের ৫টি। গত রোববার চেকপোস্টে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম ফের চালুর অনুমতি দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে বিভাগটি।

অনুমতি পাওয়া সিলেট বিভাগের চেকপোস্টগুলো হলো- সিলেটের জকিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, জুড়ীর বটুলী ও কুমারঘাট এবং হবিগঞ্জের বাল্লা। চিঠির অনুলিপি বিজিবি মহাপরিচালক, ইমিগ্রশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও দপ্তর প্রধানদের দেয়া হয়েছে।-মানবজমিন

বার্তাবাজার/এ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর