শেষ নেই চাঁদাবাজির

শেষ নেই চাঁদাবাজির। পরিবহন, ফুটপাথ, মার্কেট, ক্ষুদ্র কিংবা ভাসমান ব্যবসায়ী কারোরই যেন রেহাই নেই চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য থেকে। ভুক্তভোগীরা নীরবেই পূরণ করে যাচ্ছেন চাঁদাবাজদের চাহিদা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পুরো বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বক্তব্য, অভিযোগ ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই।

তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়াই তাদের শঙ্কার বড় কারণ। অভিযোগ উঠেছে, ঈদ মৌসুমে অতীতের মতোই বেড়ে গেছে চাঁদার হার। আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক কিংবা কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর শিল্পপতি বা বড় ব্যবসায়ীদের মাঝে এরই মধ্যে ঈদ বখরা নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখী আলোচনা। তাদের দাবি পূরণ না করলেই প্রথমে ঘটানো হবে ফাঁকা গুলির ঘটনা।

সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, হয়তো নিজের কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অতীতের মতো এবারও তারা নীরব থাকবেন। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলেই আমরা সেগুলোয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

তবে রাজধানীসহ দেশব্যাপী আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে।’ কোনো দ্বিধা না করে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রথমে ভয়ভীতি দেখাতে ওই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি করা হয়। বেশির ভাগ সময় ভয়ে ওই ব্যক্তি চাঁদা দিয়ে থাকেন চাহিদা অনুযায়ী। আর তাতে রাজি না হলে প্রকাশ্যে গুলি চালাতে তারা পিছপা হয় না।

ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ সভায় মার্কেট ও এলাকা কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি বন্ধ না হওয়ার পেছনে অনেক অসৎ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। সূত্র বলছেন, কিছুদিন ওই অসৎ সদস্যরা নিবৃত্ত থাকলেও ঈদ সামনে রেখে আবার শুরু হয়ে গেছে তাদের তৎপরতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীকেন্দ্রিক এসব চাঁদাবাজ গ্রুপের পেছনে বিদেশে আত্মগোপনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসীরাই কলকাঠি নাড়ছে। স্থানীয় গ্রুপগুলো দিয়ে চাঁদাবাজির পর ওই চাঁদার একটি বড় অংশ তাদের কাছে পৌঁছে যায়।

গত ১০ বছরে রাজধানীতে চাঁদা দাবি করে ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটেছে অন্তত শতাধিক। চাঁদা আদায়ের শুরুতে ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, ভাটারা, উত্তরা, মিরপুর, কাফরুল ও পল্লবী এলাকায়। গত ১২ নভেম্বর বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ৪ নম্বর রোডের এসটিকে পাওয়ার জেনারেটর নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শহীদুল ইসলাম টুটুলের কাছে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করেন। বলেন, ‘আমাদের টিম প্রতিটি মুহূর্ত আপনাকে ফলো করতেছে। আর না হলে আপনাকে যেটা করার বা বলার তা সামনে এসেই বলব।

সিঙ্গাপুরের বড় ভাইয়ের নির্দেশ, কাল সকালে ৫ লাখ টাকা রেডি রাখবেন। না হলে বাঁচতে পারবেন না।’ ফোন করার দুই দিন পর ১৪ নভেম্বর দুপুরে দুজন যুবক তার প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। তাদের একজন বলে, ‘তুই তো এখনো বুঝতে পারিসনি। তোকে বোঝার জন্য ফাঁকা গুলি করছি। নেক্সট টাকা না দিলে তোর বুকে গুলি ঢুকবে।’ এরপর তারা এক রাউন্ড গুলি করে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

ডিবিসূত্র বলছেন, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেনের হয়ে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছে জহিরুল। তার গ্রুপে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য। তারা মূলত ভাসমান ও অস্থায়ী ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরে বসবাস করে। মোহাম্মদপুর, বছিলা, শ্যামলী ও আশপাশ এলাকার ব্যবসায়ী, নির্মাণাধীন ভবন মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। চাঁদা না দিলে হুমকি দিয়ে ভয় দেখায। চাঁদা দিতে অসম্মত হলে ভুক্তভোগীদের বাসাবাড়ি অথবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ডাকাতি করে। গত সাড়ে পাঁচ মাস আগে শ্যামলীর একটি মোটরসাইকেলের শোরুমে ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিল এ গ্রুপের ছয়জন। কিছুদিনের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে আবার নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তারা।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গত রাতে বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের ডেকে কথা বলেছি। তারা মন খুলে আমাদের অনেক কিছুই বলেছেন। আমরাও তাদের নানা পরামর্শ দিয়েছি। ফুটপাথে ব্যবসা অবৈধ হলেও মানবিক স্বার্থে তাদের বসতে দেওয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজির বিষয়ে আমাদের তো জানাতে হবে। তবে সব বিষয়েই আমরা খোঁজ নিচ্ছি। ব্যবস্থাও তো নেওয়া হচ্ছে।’ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা-কেন্দ্রিক চাঁদাবাজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিএমপির ট্রাফিক দায়িত্ব পালন করে এমন কোনো জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে না।

অনুসন্ধান বলেছে, রাজধানীর বৃহত্তর মিরপুরে অন্তত ৪০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিটি রিকশা থেকে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার করে টাকা পাসের কথা বলে নেওয়া হয়। এর বিভিন্ন অংশ পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু সদস্যের পকেটে। মিরপুর ১০ থেকে ১২, ১৩ থেকে ১৪ ভাসানটেক, ৬ থেকে ১ ও ২। মিরপুর ৬, ১ ও ২ নম্বরে নিয়ন্ত্রণ করেন রহিম নামে এক সাবেক যুবলীগ নেতা। তিনি স্থানীয় এক কাউন্সিলরের লোক। ১০, ১১ ও ১২ নম্বরের নিয়ন্ত্রক আরেক কাউন্সিলর। বিহারি আড্ডুকে তিনি চাঁদা ওঠানোর কাজে ব্যবহার করেন। পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের হয়ে গোলাম কিবরিয়া পরিবহন সেক্টরে নিয়মিত চাঁদা ওঠান। ফুটপাথ, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ঘিরেই চলছে তাদের চাঁদাবাজির মহোৎসব। লাখ টাকা অবৈধ বিদ্যুৎ বিল ওঠাচ্ছেন স্থানীয় এক কাউন্সিলরের ছোট ভাই, ভাগ্নে মিন্টু, সাখাওয়াত হোসেন রাব্বি নামে একজন। কালশী স্ট্যান্ডে পিকআপস্ট্যান্ড বানিয়ে মামুন, জুয়েল রানা প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ওঠান বলে অভিযোগ রয়েছে।

মোহাম্মদপুর আল্লাকরিম মসজিদের সামনে থেকে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ভ্যান পার্কিংয়ের জন্য স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা নিয়মিত চাঁদা ওঠান। বুদ্ধিজীবী গেটের সামনে সপ্তাহে এক দিন বউমেলা বসানোর নাম করে প্রতিটি স্টল থেকে ওঠানো হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

এদিকে আজিমপুর-লালবাগ এলাকায় হক নামে এক লাইনম্যান পুলিশের নাম করে চাঁদাবাজি করছেন। ভিকারুননিসা থেকে ছোট দায়রা শরিফ পর্যন্ত দোকানপ্রতি দিনে ২০ ও সপ্তাহে তুলছে ২০০ টাকা। সেকশন-২ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ করছেন বিপ্লব নামে এক লাইনম্যান। ৪৭০ টাকা প্রতিদিন চাঁদা। ৭০ টার মতো অটোরিকশা।

কামরাঙ্গীর চর এলাকায় সিরাজ তালুকদার নামে এক লোক স্থানীয় কাউন্সিলরের হয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ফুটপাথের চাঁদা ওঠানোর দায়িত্ব পালন করেন। বাড়ি বিক্রি করলে কিংবা ভবন তৈরি করতে গেলে তারা বাদ সাধেন। আজিমপুর এতিমখানা থেকে ইডেন কলেজ পর্যন্ত শ্যামল নামে একজন চাঁদা ওঠান। এতিম মনির ওরফে কিলার মনির হাজার হাজার বাস রাখার জন্য চাঁদাবাজি করেন। গাড়িপ্রতি রাতে রাখার জন্য ২০০ টাকা নেন। তার সহযোগিতায় আছেন শ্যামল, মনির, কানা খোকা।

বার্তাবাজার/জে আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর