ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে

পৃথিবীতে বাঙ্গালী ব্যতীত অন্য কোন জাতি ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে বলে আমার জানা নেই। নিজের মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য “ভাষা আন্দোলন” নামে একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষ্য হয়েছে।

কোটি বাঙ্গালীর মুখের ভাষাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্থান সফরকালে রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা দিয়েছিল উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তখন সমাবেশ স্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পরে। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে সারা দেশ প্রতিবাদ মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার জন্য ১৪৪ ধারা ভেংগে সমাবেশ কালে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলিতে নিহত হয় রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত এবং হাসপাতালে পরবর্তিতে মৃত্যু বরণ করে আব্দুস সালাম। সেই থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে। পাকিস্থানের স্বৈরাচারেরা মুখের ভাষা পর্যন্ত কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ভাষার ক্ষেত্রেই তাদের এত বিরোধিতা বা অবমূল্যায়ন ছিল, অন্য সব ক্ষেত্রে তাদের আচরন বাঙ্গালীর প্রতি কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। নানা ত্যাগ ও তীতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই মধুর মাতৃভাষা।

২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। ভাষার মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত ভাষাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার উপর বিভিন্ন সভা-সেমিনার, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা এবং বানান শুদ্ধির আয়োজন করে থাকে।

ভাষার প্রভাব এবং সৌন্দর্য সবার কাছে পুস্তকের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে মাস ব্যাপী জাতীয়ভাবে বই মেলার আয়োজন করা হয় । আবার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলে ভাষাকে উন্মুক্তভাবে চর্চার আগ্রহ তৈরি করতে পৃথক পৃথক ভাবে বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

তবে এসব কর্মকান্ড শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরেই হয়। বর্তমানে ভাষার প্রতি নতুন প্রজন্মের যে আগ্রহ কম সেটা খুব সহজেই বুঝা যায় যদি আমরা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেই । অধিকাংশ শিক্ষার্থী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে না। লেখার ক্ষেত্রে বানান ভুলের যেন প্রতিযোগিতা লেগে যায়। আমাদের দেশে প্রত্যেকটি জেলা বা অঞ্চলের মানুষের ভাষার উচ্চারণ বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়।

এসব উচ্চারণ বৈচিত্র ভাষাকে সৌন্দর্য দান করেছে বটে কিন্তু পূর্ণতা দেয়নি। পূর্ণ ভাষা শেখার কোন সৎ প্রচেষ্টা আমাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। আমি খুব কম শিক্ষককে দেখেছি ভাষা শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জোগাতে । শিক্ষার্থীদের উৎসাহের বিষয় তো পরের কথা অনেকের নিজের উচ্চারণও সঠিক হয় না।

আমরা সদাসর্বদা ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি কিন্তু নিজের মাতৃভাষা পূর্ণভাবে রপ্ত না করে আমরা কিভাবে অন্য ভাষার পারদর্শীতা অর্জন করতে পারি ? আমরা কেনই বা আমাদের মাতৃভাষায় সুন্দর শব্দচয়নে মনযোগী হই না? আমরা কেন আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য সম্পদের রহস্য বুঝতে চেষ্টা করি না? শুধু ফেব্রুয়ারিতে ভাষার মাস হিসেবে ভাষাকে কেন্দ্র করে জমকালো কিছু অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নিলেই ভাষার প্রতি আন্তরিকতা আছে বলা যায় না।

ভাষার মাস ছাড়াও অন্য সব সময়ে বাংলার প্রতি ভালবাসা যেন আমাদের মধ্যে থাকে সেটার প্রতি নজর রাখতে হবে। একটি ভাষার মধ্যে চারটি উপাদান নিহিত থাকে, পড়ে বুঝা, বুঝে লিখা, শুনে বুঝা এবং বুঝে বলা। প্রত্যেকটি উপাদানের সাথে বুঝা বিষয়টি সাধারন ভাবে জড়িত।

এখন এই চারটি বিষয় আমাদের মধ্যে প্রয়োগ করে দেখি কতটুকু ভাষা শিখতে পেরেছি। পরিশেষে যাদের রক্ত এবং আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই ভাষা পেয়েছি , আমরা যদি এই ভাষার যথাযথ কদর করতে না পারি তাহলে তাদের রক্ত এবং আত্মত্যাগকে অসম্মান করা হবে। তাই ভাষার প্রতি ভালবাসা শুধু ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ না রেখে সবসময় উন্মুক্ত রাখতে হবে।

শফিকুল/বার্তাবাজার/আর এম সা

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর