ত্রিনক্ষত্রের পতন

উপমহাদেশের সংগীত জগতে যেনো শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একে একে বিদায় নিচ্ছেন গত কয়েক দশক ধরে সংগীতের মাধ্যমে মাতিয়ে রাখা নক্ষত্ররা যারা সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছিলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। হঠাৎ করেই শোক যেনো নাড়া দিয়ে বসেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। প্রস্থানের হিড়িকে আজ গানের পাখিরা গত হচ্ছেন কিছু সময়ের ব্যাবধানে। যা খুবই বেদনাদায়ক।

বলা হচ্ছিলো তিন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপ্পি লাহিড়ীর অন্তিম প্রস্থানে যারা গ্রামোফোন থেকে আজকের ইউটিউব, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে বারংবার, কিন্তু দর্শক জনপ্রিয়তায় তারা ছিলেন ধ্রুবক যাদের কণ্ঠের যাদুতে মুগ্ধ ছিলেন উপমহাদেশে কোটি মানুষ।

লতা মঙ্গেশকর : গত ৬ই ফেব্রুয়ারি লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লতা মঙ্গেশকর । ৯২ বছরের সফল এক যাত্রায় তিনি ছিলেন একজন অনুকরনীয় ও অনুসরনীয় ব্যাক্তিত্ব। বলা হয়ে থাকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বকালের সফল গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার গানের ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে তিনি গেয়েছেন প্রায় ৩০ হাজারেরো বেশি গান। ভারতের রাজ্যভিত্তিক প্রায় প্রতিটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন এই বরেণ্য এই শিল্পী । পেয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারত রত্ন’। এ ছাড়াও দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, অসংখ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ সব প্রাপ্তিই যুক্ত হয়েছে তার ঝুলিতে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় : প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও প্লেব্যাক গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও আর নেই । লতাজির প্রস্থানের ৯ দিন পর তারও প্রস্থান। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তৃণমূল সংসদ সদস্য শান্তনু সেন এর টুইটে প্রথম এই হৃদয়বিদারক তথ্য সামনে আসে যা ছিলো নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। গত ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবাদ প্রতিম এই সংগীতশিল্পী। সেদিনই তাকে কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
জানা গিয়েছিলো, ফুসফুসের সংক্রমণ তার জীবনের নার্ভাস নাইন্টিনের আউট হবার অন্যতম একটি কারন। উল্লেখ্য মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগেই কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের মনোনীত ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানতা পদ্মশ্রী পদক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। যদি তা গ্রহন করার মানসিকতা থাকতোও তবুও রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে সেই সম্মাননা নেবার উপলক্ষটা সৃষ্টিকর্তা হয়ত তাকে দিতেনও না।

কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তার সংগীত শিক্ষার মূল কান্ডারি ছিলেন দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে প্রথমবার সিনেমায় প্লেব্যাক করেন, সিনেমার নাম ‘অঞ্জনগড়’। ওই বছর তার কণ্ঠে আরও তিনটি গান প্রকাশিত হয়। যার সুবাদে গায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান দেশব্যাপী। ১৯৫০ সালে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলা বেসিক আধুনিক গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা। ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক করেন তিনি। শচীন দেব বর্মনের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তার বম্বে সফর। তবে সেখানে সন্ধ্যার প্রথম প্লেব্যাক করিয়েছেন সুরকার অনিল বিশ্বাস। সিনেমার নাম ‘তারানা’। গেয়েছিলেন বিখ্যাত বাংলা গান মধু মালতী ডাকে আয়, যে গান আজো চিরসবুজ।

বাপ্পি লাহিড়ী : লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর শোকের আবহ কাটিয়ে না উঠতেই এক দিনের ব্যাবধানে তৃতীয় কোন আইকনিক শিল্পীর প্রস্থানে শোকে কাতর পুরো বাংলা সহ ভারতবর্ষ। ৬৯ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন সবার প্রিয় বাপ্পী দা।

৭০ থেকে ৮০-এর দশকে বোম্বের সিনেমা জগতে অন্যতম জনপ্রিয় নাম এই বাপ্পি লাহিড়ী।বাংলায় অমর সঙ্গী, আশা ও ভালোবাসা, আমার তুমি, অমর প্রেম সহ হিন্দিতে ডিস্কো ডান্সার, চলতে চলতে, শরাবি সহ অনেক ছবিতে সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন একাধিক গান। ২০২০ সালে তার শেষ গান বাগি-৩ সিনেমায়। বলিউড সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তীর ডিস্কো ড্যান্সার তকমার পেছনেও ছিলেন এই জনপ্রিয় শিল্পী ।

একে একে তিনজন কালজয়ী শিল্পীর প্রস্থান। শিল্পী চলে যায়, রয়ে যায় তার সৃষ্টি করা শিল্প। ব্যাক্তি মানুষ হিসেবে এই সুন্দর পৃথিবীতে আর নেই লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিংবা বাপ্পী লাহিড়ী। কিন্তু তাদের সৃজনশীল কাজ, মনোমুগ্ধকর গান তাদের বাচিয়ে রাখবে হাজার বছর।

রবীন্দ্রনাথ তার সোনার তরী কবিতায় অনেকটা পরোক্ষভাবেই বলে গিয়েছেন,
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী,
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

 

বার্তাবাজার/ এম এইচ আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর