মুখ থুবড়ে পড়েছে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা।

শিক্ষক-কর্মচারী সংকট সহ নানান সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৩১জন শিক্ষকের বিপরীতে ৫ জন,৭ জন কর্মচারীর বিপরীতে আছে ১ জন।
শিক্ষকদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধানসহ ৩ জনই ধর্মীয়, কর্মচারীর মধ্যে আছে ১জন পিয়ন। গত ১যুগ বছর ধরে চলে আসছে বিদ্যালয়ে এ নাজুক অবস্থা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে এখন ৯০০ থেকে এখন ৫৬৪ জন।
এমন পরিস্থিতিতেও শিক্ষক পুরণ না করে শিক্ষক বদলি করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা।

মানসম্মত শিক্ষা দুরের কথা নুন্যতম শিক্ষাও পাচ্ছে না এই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। বিজ্ঞান পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো বেগতিক। সন্তানকে সুশিক্ষত করতে চরম বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন স্থানীয়রা।

বিদ্যালয় সুত্রে জানা যায়, ১ জুলাই ১৯৬৭সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৮১ সালে জাতীয়করণ হয় লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। সে থেকে পরিপুর্ণ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছিল বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ের সুনাম ও ঐতিহ্যে অন্য উপজেলা থেকে একসময় শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতো এখানে। মূলত ২০১০ সালের পর থেকে শিক্ষক-কর্মচারী সংকটে শিক্ষার পরিবেশে ব্যাপক ধস নামতে শুরু করে। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য, কারিগরি বিভাগসহ বর্তমানে প্রায় ৬’শ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে বিদ্যালয়ে। শিক্ষার জনবল কাঠামো অনুসারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা-৪, ইংরেজি-৪, গণিত-৩, সামাজিক বিজ্ঞান-৩, ধর্ম-২, ভৌত বিজ্ঞান-২, ব্যাবসা শিক্ষা-১, ভুগোল-১, চারুকলা-১, শারীরিক শিক্ষা-১, কৃষি শিক্ষা-১, কারিগরি শাখায় কম্পিউটার-২, ড্রেস মেকিং-২জনসহ ৩১জন শিক্ষক এবং অফিস ব্যবস্থাপনায় উচ্চমান সহকারি-১ জন, নিম্মমান সহকারি-১ জন, অফিস সহায়ক- ৫জনসহ ৭জন কর্মচারী থাকার কথা। কিন্তু চাহিদাপত্রে দেখা যায় ৭জন কর্মচারীর মধ্যে পিয়ন ১ জন, ৩১জন শিক্ষকের মধ্যে আছে মাত্র ৫ জন শিক্ষক। আবার এই ৫ জনের মধ্যে রয়েছে আবার ১জন ভৌত বিজ্ঞান, ১জন কৃষি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধানসহ ৩জনই ধর্মীয় শিক্ষক।

একযুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে এ করুণ অবস্থা। বর্তমানে ৩১ শিক্ষক পদের মধ্যে ২৬, ৭ অফিস সহায়ক পদের মধ্যে শুণ্য রয়েছে ৬টি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষক বদলি করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ২০২১ সালের অক্টোবরে বিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিল ৭জন। সেখান থেকে নভেম্বর মাসে ক্রীড়া শিক্ষক সঞ্জয় বড়ুয়া, ডিসেম্বর মাসে ইংরেজি শিক্ষক দীপন চৌধুরী, ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষক মোহাম্মদ নেছারুল হক খানকে বদলি করা হয়। ৭জন থেকে ৩ জন শিক্ষক বদলি করায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কান্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্কুলের অভিভাবক ও স্থানীয় জনসাধারণ।

উপজেলা মাধ্যমিক অফিস সুত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের বদলি করে থাকেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একজন শিক্ষক বদলি হতে প্রধান শিক্ষকের আপত্তি নাই (নো অবজেকশন) সম্মতি পত্রের প্রয়োজন রয়েছে।

স্কুলের অভিভাবক ও স্থানীয় জনসাধারণ বার্তা বাজারকে বলছেন, এসবের তোয়াক্কা করছে না মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষকের সম্মতিপত্র ছাড়াই অতিরিক্ত ঘুষ বাণিজ্যে শিক্ষকদের বদলি করেন। এতে করে ভেঙে পড়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুলে কয়জন শিক্ষক আছে, একজন শিক্ষক বদলি করলে শিক্ষার্থীদের কি হবে চিন্তা করেনা দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তারা। তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য তুচ্ছ।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র উদয়ন বড়ুয়া বার্তা বাজারকে বলেন, আমাদের সময়ে বিদ্যালয়ের সোনালী যুগ ছিল। পার্শবর্তী অন্যান্য উপজেলার স্কুলের চেয়ে এই স্কুলের পড়ালেখা ও ফলাফল ছিল ভাল। সেময় আর বর্তমান সময় চিন্তা করলে আমাদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করে। উন্নয়নের অগ্রগতি ও ডিজিটাল যুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার এমন পরিবেশ কোনমতেই মেনে নেওয়া যায়না। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে উপর মহল শিক্ষক বদলি করে স্কুলটাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ভৌত অবকাঠামোসহ নানামুখী উদ্যোগ নিলেও মানসম্মত শিক্ষার ছিঁটেফোটা নেই লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। শিক্ষক সংকটে একসময়ে আলো ছড়ানো প্রদীপটি এখন নিবুনিবু। নতুন বছর শুরু হলে সন্তানকে কোথায় ভর্তি করাবে এ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে অভিভাবকের কপালে। আর্থিক অস্বচ্চলতার কারনে নিরুপায় হয়ে জেনেশুনে এখানে ভর্তি করে সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

অপর এক ছাত্র অভিভাবক ফারজানা ইয়াছমিন আক্ষেপ করে বলেন, ৫জনের মধ্যে ৩ জন ধর্মীয় শিক্ষক হলে এখানে আর কি আশা করা যায়। তাই এখন মানসম্মত শিক্ষা নয় কোন রকমে যোগ, বিয়োগ, গুন ভাগ শিখানোর নিশ্চয়তা চাই।

শিক্ষকের দাবীতে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-অভিভাবকরা আন্দোলন, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দিয়েও এর কোন প্রতিকার পাননি। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আজিজুল হক নিজামী প্রায় ৬’শ শিক্ষার্থীর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন,৩০ অক্টোবর ২০১৯ সালে যোগদান করে বিদ্যালয়ের এই করুণ অবস্থা দেখতে পাই। তারও একযুগ আগে থেকে চলে আসছে এই অবস্থা। বারবার চাহিদাপত্র প্রেরণ করেও শিক্ষক পাওয়া যায়নি। মাঝেমধ্যে কিছু শিক্ষক দিলেও প্রধানের সম্মতি ছাড়াই জোর তদবিরে বদলি হয়ে চলে যায় তারা।

লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল বার্তা বাজারকে বলেন, ১ যুগের বেশি সময় ধরে শিক্ষক-কর্মচারি সংকটে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে। অভিভাবকরা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। শুধুমাত্র শিক্ষক ও কর্মচারী সংকটের কারণে বেহালদশা বিদ্যালয়টির।

বার্তাবাজার/ আর এম সা/ মিজানুর রহমান

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর