প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন: পাস হলে সুযোগ-সুবিধা কমবে সাংবাদিকদের

গনমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হলে নানা সমস্যায় পড়বে গনমাধ্যমকর্মীরা তাই ইতোমধ্যে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা বলছেন, আইনটি পাস হলে বিনোদন ছুটি, গ্র্যাচুয়িটিসহ সাংবাদিকদের বিদ্যমান অনেক সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। একই সঙ্গে সাংবাদিক ও কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে। সাংবাদিক নেতাদের দাবি, মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন হওয়ার পর গণমাধ্যমকর্মী আইনের খসড়া থেকে সাংবাদিকদের বিদ্যমান অনেক সুযোগ-সুবিধা কেটে অর্ধেক করা হয়েছে, যা একেবারেই কল্পনাতীত ও অমানবিক। এটি পাস হলে গণমাধ্যমকর্মীদের তেমন কোনো কল্যাণে আসবে না। তাই বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দিয়ে আইনটি পাসের সুপারিশ করার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা।

সাংবাদিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনের খসড়া ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। কিন্তু পাস করার জন্য দীর্ঘদিনেও আইনটি সংসদে উত্থাপিত না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছিল সাংবাদিক সংগঠনগুলো। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে আইনটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপিত হবে। এরপরই আইনটি নিয়ে সাংবাদিকরা নতুন করে খোঁজখবর শুরু করেন। তখন জানতে পারেন চূড়ান্ত হওয়ার সময় আইনের খসড়া থেকে সাংবাদিকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করা হয়েছে। যেমন- প্রস্তাবিত আইনের ২০-এর ৩ উপধারায় গ্র্যাচুয়িটি ৩০ দিনের কথা বলা হয়েছে। অথচ বিদ্যমান শ্রম আইনে গ্র্যাচুয়িটি ৬০ দিন। ১২-এর(ক) ও (খ) উপধারায় কর্মীকে ছাঁটাই করলে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১ মাসের বেতন দিতে হবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বিদ্যমান শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে চার মাস। প্রস্তাবিত আইনে বিনোদন ছুটি ১ মাসের পরিবর্তে ১৫ দিনের কথা বলা হয়েছে। ৫(৫) ধারায় শিক্ষানবিশ সময়কাল ৬ মাসের পরিবর্তে ১ বছর করা এবং ১২(১) ধারায় অতিরিক্ত কর্মী থাকলে মালিক ছাঁটাই করে সরকারকে অবহিত করার কথা প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো কর্মীকে অসুস্থতার জন্য ডাক্তারি সার্টিফিকেট দিয়ে অব্যাহতি দিতে পারবে। ২(৫) ধারায় গণমাধ্যম কল্যাণ সমিতি এবং ২৫(২) ধারায় সাংবাদিক কল্যাণ সমিতির কথা বলা হলেও ট্রেড ইউনিয়নের কোনো কথা উল্লেখ নেই।

বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক সময়ের আলোকে বলেন, সাংবাদিকদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন প্রস্তাবিত অবস্থায় পাস হলে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছুই থাকবে না। এই আইনের ৪৭ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা আইএলও কনভেনশনবিরোধী। এই আইনটির ফলে সাংবাদিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাতে পারেন। ফলে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তারা আন্দোলন করতে পারবেন না। সাংবাদিকরা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না। ফলে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। এ কারণে বিএফইউজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনটি সংসদে উত্থাপনের পর যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে তখন বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের প্রস্তাব সংসদীয় কমিটির কাছে লিখিতভাবে জানাবে। একই সঙ্গে কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।

বিএফইউজের সাবেক সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল সময়ের আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে বিএফইউজে ও সংবাদপত্র কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আইনে আমরা কী চাই তা লিখিতভাবে দিয়েছিলাম। আইনের যে খসড়াটি মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন হয়েছিল, সেখানেও সব ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর যখন সচিব কমিটিতে পাঠানো হয় সেখানে খসড়ার অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে, যা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের জানানো হয়নি। তিনি বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়নের বর্তমান নেতারা আইনটির ত্রুটিগুলো তুলে ধরছেন। তাই বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন না করে আইনটি পাস করা উচিত হবে না। তিনি বলেন, আমরা হয়তো সংসদে ওঠার পর সংসদীয় কমিটিতে গিয়ে মতামত দিতে পারব। সংসদীয় কমিটির উচিত হবে সাংবাদিক ইউনিয়নসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেই আইনটি চূড়ান্ত করা। কারণ অতীতে আমাদের ভালো-খারাপ দুধরনের অভিজ্ঞতাই আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের আগে আমাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু তথ্য অধিকার আইনে আমাদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। এতদিন শুধু পত্রিকার সাংবাদিকরা আইনের আওতায় আছেন। কিন্তু এবার সব ধরনের গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। তবে আইন করতে গিয়ে যেন খারাপ কিছু না করা হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

এদিকে বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ মামুনুর রশীদ শনিবার এক বিবৃতিতে গণমাধ্যমকর্মী আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সাংবাদিকদের সব ধরনের ন্যায্য দাবি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নেতারা বলেন, সত্তর ও আশির দশকে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত সুবিধাদি বর্তমান সমাজে অন্যান্য পেশাজীবীর তুলনায় অতি সামান্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পেশার মানুষ অনেক বর্ধিত সুবিধা ভোগ করছে। নবম ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদে সাংবাদিকদের দুটি গ্র্যাচুয়িটি বহাল রাখে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিসভা কমিটি এই গ্র্যাচুয়িটি একটি করে প্রস্তাব করে, যা সাংবাদিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে চলমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায়; কিন্তু কমানোর কোনো বিধান নেই। এখন আবার গণমাধ্যমকর্মী আইনে অবশিষ্ট সুবিধাদি কর্তনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। সাংবাদিকদের রুটি, রুজি, মর্যাদার আন্দোলনে কাজ করে সাংবাদিক ইউনিয়ন। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। বিএফইউজে নেতারা বলেন, সত্তর দশকে নির্ধারিত সাংবাদিকদের জন্য বছরে দুটি গ্র্যাচুয়িটি এখন চারটি করার দাবি উঠেছে। অথচ প্রস্তাবিত আইনে ওই গ্র্যাচুয়িটি কমিয়ে একটি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে সব সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করা হয়েছে, যা বিস্ময়কর ও অনভিপ্রেত।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ গত ২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, ‘গণমাধ্যমকর্মী আইনের খসড়া ইতোমধ্যেই আইনমন্ত্রী স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে সেটি সংসদে নিয়ে যেতে পারব বলে আশা করছি। আইনটিতে সাংবাদিকদের বেতন, ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ছুটিসহ আরও নানা বিষয়ে সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এই আইনটি পাস হলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ায় যারা কাজ করেন তাদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর