সামাজিক নিরাপত্তায় তৃতীয় লিঙ্গের অবস্থান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অঙ্গীকার নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তৃতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর দেশের সকল শ্রেণির মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্তি, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়।

সামাজিক নিরাপত্তা হলো এমন একটি নিরাপদ বেষ্টনী, যার মাধ্যমে সমাজের অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। এটি একটি দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা কর্মসূচির একটি অংশ মাত্র। দেশে জনগণের প্রয়োজন অনুসারে সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়ে থাকে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন কর্মসূচি ও আইনগত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে পরস্পর সহবস্থান এবং সম্পৃতির একটি সুষম পরিবেশ তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগের ফলে মানুষের মধ্যে সংঘটিত অনাকাক্ষিত অবস্থা মোকাবিলা করা, বিভিন্ন আইনি সহায়তা প্রদান, অসুস্থতায় সহায়তা দান এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। তাই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের সামাজিক নীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তায় জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের সংখ্যা জানা অতি জরুরি। বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকেই জনসংখ্যার এ ক্ষুদ্র অংশ তৃতীয় লিঙ্গের বসবাস এবং সবসময় অবহেলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবেই পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান,
স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজে মূল শ্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্তকরণ অতি জরুরি হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমান সরকার এ অনুযায়ী কাজ শুরু করে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপকৃত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে।

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দের পরিভাষা `Transgender’ কে বিজ্ঞানের পরিভাষায় মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, ক্রমোজমের ত্রুটির কারণে এই শ্রেণির জন্মগত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাকে দৈহিক ও জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে এই জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানের ভাষায় পুরুষের অন্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং নারীদের ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত হয় প্রজেসটেরন, এক্ষেত্রে ভ্রুনের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্ন সৃষ্টি হয় যেমন xxy অথবা xyyi এবং এর ফলে বিভিন্ন গঠনের তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর জন্ম হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে পছন্দ করেন না, ভালো চোখে দেখেন না তাদের। এমনকি তাদের সাথে কথা বলতেও পছন্দ করেন না এবং তাদেরকে দেখলে এড়িয়ে যান। বাস্তবিক অর্থে তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি অন্যভাবে অনুধাবন করা উচিত। পেটের দায়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন উপায়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য ও আবাসনের চেষ্টা করে থাকেন। তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজে নানাভাবে অবহেলিত। কাজেই তাদের বিষয়টি সমাজের সকল স্তরের মানুষের সুদৃষ্টিতে বিবেচনা করা উচিত।
নিন্দা আর লজ্জা ঢেকে রাখার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন করা সম্ভবপর না হলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভয়-লজ্জা, আড়ষ্টতা ও হীনমন্যতা আরো বাড়বে। নিজেকে ছেলে বা মেয়ে বলে সমাজে একটি ছদ্ম পরিচয় দিয়ে সে যখন বেড়ে উঠবে তখন তার মনের মধ্যে জমা হয় ক্লেদ, দুঃখ ও বঞ্চনা। ফলে সে কিছুতেই নিজেকে মূল জন অংশ মনে করতে পারেনা। লোকভয়ে একটা সময়ে তার নিজ পরিবারও তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানকে দায় মনে করে। এমন পরিস্থিতিতে তারা পরিবার থেকে পালিয়েই যেনো মুক্তি, এমন ভাবনায় ঘর ছাড়া হয়ে যায় তারা শেষপর্যন্ত।

নির্ভার হয়ে বাঁচতে একসময় তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষেরা খুঁজে নেয় তাদের আলাদা সমাজ। নেয় গুরুমায়ের কাছে দীক্ষা। রপ্ত করতে থাকে হাতে তালি বাজিয়ে কোমর দুলিয়ে মুখে কড়া মেক-আপ মেখে নাচ গানের তালিম। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই তৃতীর লিঙ্গের মানুষ নামেন যৌনকর্ম ও চাঁদাবাজি পেশায়। নিজের থাকা-খাওয়া বাসস্থানের জন্য কঠিন সংগ্রামে নামতে হয় তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়কে। সামাজিক কুসংস্কার ও বিভিন্ন কারণে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না, ফলে তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়কে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে সরকারি উপবৃত্তি প্রদান করে সরকার। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের সম্পৃক্ত করে তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় আনার প্রচেষ্টা করেছে সরকার। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান পরিবার ও সমাজে সম্মান বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তাদেরকে আমাদের মূল শ্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব।

সরকারের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পাঁচ বছরের উপরে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান। আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান ও তাদের আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্তকরণ। সমগ্র বাংলাদেশে অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনের ৬৪টি জেলা, সকল উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও পল্লী এলাকার ইউনিয়ন পরিষদে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে আনুপাতিক হারে কার্যক্রমের আওতাভূক্ত করাও সরকারের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রণীত নানামুখী কর্মসূচি তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ত করবে। এই প্রক্রিয়া জেলা সমাজসেবা কর্যালয় এবং উপজেলা ও শহর সমাজসেবা কার্যালয়সমূহের সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান জনবল, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং নির্বাচিত এনজিগুলির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।

মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কার্যক্রমের আওতায়ও সার্বিক তত্বাবধানে মন্ত্রিসভা কমিটি এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের সার্বিক তত্বাবধান করবে। তাছাড়া জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জেলা স্টিয়ারিং কমিটি এবং জাতীয় পর্যায়ে স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হবে।

আজকাল বিভিন্ন পেশায় তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী চাকুরি করছে এবং এভাবে তাদেরকে সমাজের মূলশ্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে সরকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ সবই বর্তমান সরকারের বিশেষ অবদান। এ কথা অনস্বীকার্য, অতীতে কখনোই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নকে গুরুত্বের সাথে নজর দেয়া হয়নি। অতি সম্প্রতি সংখ্যায় কম হলেও তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষকে চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও আরো কিছু প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সাথে কাজ করতে পারছেন এ জনগোষ্ঠীর মানুষ এখন।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান পাওয়া অন্যতম একটি বিষয়। তাই দারিদ্র্যবিমোচন, বৈষম্য কমানো এবং প্রান্তিকজনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষের বঞ্চনা ও লাঞ্চনার বিপরীতে সবার সাথে সাথে এ জনগোষ্ঠীর মুখেও হাসি ফুটবে – এমন অঙ্গীকার এবং প্রত্যয় নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা কাজ করতে পরি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো জোরদারভাবে দারিদ্র্যপিড়ীত মানুষগুলোর সাথে সাথে তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর জীবনে আরো বেশি নিরাপত্তা দিবে, সুখ স্বাচ্ছন্দে ভরিয়ে দিবে তাদের জীবন এ প্রত্যাশা নিশ্চয়ই আর অবাস্তব হবে না। অবাস্তব নয় মোটেই।

জাহাঙ্গীর হাফিজ, ফ্রিল্যান্স রাইটার, দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা।
পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।

 

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর