মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কারাবন্দীর খোঁজে একদিন

লকডাউনের সময় একদিন সকালে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠে। প্রথমে ভাবলাম অফিসের ফোন। পরে দেখি বাংলাদেশের একটি অপরিচিত নাম্বার। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ষাটোর্ধ নারী করুণ কন্ঠে বলে উঠলো, “বাবা তুমি সামবাদিক? আমার ছেলে সোহেলকে পুলিশ ধইরে নিয়ে গেছে মেলা দিন, কই নিয়ে গেছে জানিনে, তুমি ছেলেডারে খুইজে বের কইরে দ্যাও। তোমারে কলিজা ভরে দোয়া দেবানে। সে আমার বড় ছেলে। তার চিন্তায় আমার ঘরে খানাপানি নেই”।

জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে ফোন করলেন আর আমার নাম্বার টা কোথায় পেলেন? তিনি বললেন গোপালগঞ্জ থেকে বলছেন। আর নাম্বার পাওয়ার ব্যপারে সদুত্তর দিতে পারেননি। এরপরই উনি কাকুতি মিনতি করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন। পরিবারের বড় সন্তান হারিয়ে তিনি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। সেটা তার আহাজারিতেই বুঝতে পারছি। এভাবে কয়েকদিন ফোন করে অনুরোধ করার পর আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীকে নিয়ে বৃদ্ধার ছেলে সোহেলকে খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলাম।

বিভিন্ন কারণে আটক মালয়েশিয়ায় কারাবন্দীদের সম্পর্কে বাইরে থেকে জানা খুব একটা সম্ভব হয় না। কারার ওই লৌহ কপাটের চার দেয়ালের ভিতরে আদতে কি হচ্ছে এবং সেখানের পরিবেশটা সব সময়ই অজানা থাকে যারা বাইরে আছেন তাদের কাছে। এমনকি যারা কারাগারের ভিতরে আছেন তারাও বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার জেলখানার নিয়ম নীতিরও বিস্তর ফারাক রয়েছে। বাংলাদেশে সহজ প্রক্রিয়ায় বন্দীদের সাথে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ করা এবং খাবার আদান প্রদান করা গেলেও মালয়েশিয়ায় এই নিয়ম নেই। রয়েছে আরো নানা জটিলতা। এখানে বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই অবৈধতার কারণে আটক হয়। খুনখারাবি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে খুব কমই কারাবন্দী হন। কারণ দেশটিতে অপরাধ কর্মকাণ্ড এশিয়ার অন্যন্যা দেশের তুলনায় অনেক কম হয়। নানা কারনে দেশটির জেল খানা কে ভয়ংকর হিসেবে সবাই জানেন। কেউ কেউ একে সাক্ষাৎ জাহান্নাম আখ্যা দেন। আবার কেউ কেউ মূখ খুলতেই রাজি নন। এজন্য অবৈধ হয়ে মালয়েশিয়া আসা অথবা দেশটিতে অবৈধ হয়ে থাকা মানে যমদূতের সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকা। কারণ দূদিন আগে অথবা পরে যেকোন সময় ধরা পরতেই হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর হাতে। আর তাদের হাতে ধরা পড়লে জেলে না গিয়ে ছাড়া পাওয়ার আশা খুবই কম। তাই অবৈধভাবে মালয়েশিয়া আসার আগে বার বার এসব দূর্গতির কথা চিন্তা করা উচিত। ছয় বছর ধরে মালয়েশিয়ায় সাংবাদিকতা করছি। দেশটির জেল খানার নিষ্ঠুরতা ও রহস্যময় কর্মকান্ডের কথা শুনেই আসছি সরাসরি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি।

যদিও সারা পৃথীবির মত মালয়েশিয়াতেও কঠোর লকডাউন চলছে। এর মধ্যে হাজার হাজার বন্দীর মাঝে বাংলাদেশী বন্দী খোঁজা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতই। কিন্তু সন্তান হারা এক বৃদ্ধা মায়ের আকুল আকুতির কথা বিবেচনা করে আমার সাংবাদিক সহকর্মী কে নিয়ে সোহেলকে খুজতে বের হলাম। স্বিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে দুই মাস পার হয়ে গেছে তাই আমাদের রাজধানীর আশেপাশে কোন বড় জেলখানায় খোঁজ নিতে হবে। তবে এ বিষয়ে আমাদের ধারনা আছে প্রথমে অবৈধ হিসেবে আটকের পর ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে রাখা হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করার পর বিচারক জানতে চান পুলিশ যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে তা সত্য কি না। যদি মিথ্যা হয় সেটা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে প্রমান করতে বলা হয়। পর্যাপ্ত ডকুমেন্টস না থাকলে তার কারাদণ্ড হয়ে যাবে। অবৈধ হিসেবে আটক হলে তিন থেকে ছয় মাস কারাদণ্ড হতে পারে। সাথে দোররা মারার শাস্তিও হয়। তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন জেল খানায়। সেখানে সাজার মেয়াদ শেষ হলে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রাখা হয়। রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে দেশের সবচেয়ে বড় সিমুনিয়া জেলখানায় রওয়ানা দিলাম মোটরবাইক চেপে। পাহাড়ের বুক চিড়ে উঁচুনিচু উন্নত রাস্তা, দূপাশে অপরুপ সৌন্দর্য গুলো পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কোলাহল ও যানজট মুক্ত রাস্তা দিয়ে ৩৫ কিলোমিটার পৌঁছে গেলাম মাত্র ৩০ মিনিটে ই। এর জন্যেই এ দেশ কে এশিয়ার ইউরোপ বলে।

সেখান পৌছে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম সেটার বর্ননা ই আজকের লেখার উদ্দেশ্য। আমরা সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে সাধারণ প্রবাসী হয়ে গেলাম কারণ সাংবাদিক পরিচয় দিলে কোন তথ্য ই দিবে না অন্যথায় হাইকোর্ট দেখাতে চাইবে। জেলখানার মেইন গেইটের বাম পাশেই তথ্য অনুসন্ধান কেন্দ্র রয়েছে। অবাক হলাম দেশের এতবড় জেলখানা গেইটের সামনে একজন দর্শনার্থীও নেই। নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া কাউকে পেলাম না। হ্যান্ড স্যানিটাইজ ও স্ক্যান করে প্রবেশ করে দেখলাম একজন সামরিক পোশাকে মোবাইলে মগ্ন একজন অফিসার আর অন্যজন সাদা পোশাকে কাউন্টারে বসে আছে। এছাড়া আর কেউ নেই এতবড় বিশাল হলরুমের ভেতরে। আমাদের পিছনে পাকিস্তানী এক প্রবাসী যুবক প্রবেশ করেছে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য। আমাদের কাছে সিভিল পোশাকের ব্যক্তিটি জানতে চাইলেন কিসের জন্য এখানে আসলাম এবং আমাদের কাছে মালয়েশিয়ার বৈধ ভিসা আছে কি না? আমরা যথাযথ উত্তর দেওয়ার পর বসতে বলা হলো। পাকিস্তানী যুবকটি কে ও একই প্রশ্ন করে বসতে বলা হলো কিন্তু সে বসতে একটু দেri করায় অফিসার টি বাঘের মত হুংকার করে বলে উঠলো বসছ না কেন? সেই হুংকার টা এতবড় খালি হলরুমের পাশের দেওয়ালে প্রতিধ্বনীত হয়ে ফিরে আসলো। আবার ও অফিসারের চিৎকার, “আওয়া পাহাম কা তা পাহাম? ” বাংলায় এর অর্থ হয় তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো নাকি বুঝতে পারনি? লোকটি দাড়িয়ে কাপছে সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমরা বুঝতে পারলাম মালয়েশিয়ান ভাষা তাড়াতাড়ি না বুঝতে পারায় অফিসার ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। অফিসার হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলে উঠলো” আপা মাও? ” এর অর্থ তুমি কি চাও? সে এবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা মালয়েশিয়ান ও ইংরেজিতে বুঝানোর চেষ্টা করছে সে তার দেশের একজন কে খুজতে এসেছে। হাত দিয়ে ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বললো “এখানে বস “। এবার বুঝতে পেরে বসার পর শুরু হলো জেরা এটা এনেছো কি না ওটা এনেছো কি না? এই জেরার মাঝে সমানতালে চলছে ধমক আর ছোটখাটো হুংকার। আমার মনে হলো এই মানসিক অত্যাচারে লোকটি যে তথ্য নিয়ে এসেছে সেগুলো সে বেমালুম ভুলে গেছে। ঠিক তাই হলো। লোকটি বাইরে গিয়ে ফোন করে আরো তথ্য জানার জন্য অনুমতি চাইলো এবং বাইরে চলে গেল। তারপরই আমাদের ডাক এলো। আমরা এতক্ষণ সব দেখছিলাম। তাই মালয়েশিয়ান ভাষায় কথা না বলে ইংরেজি কথা বলা শুরু করলাম। মানে আমরা নিজেরা শিক্ষিত ভদ্র লোকের মত নিজেদের উপস্থাপন করলাম। তাতেই কাজ হয়েছে এবার দেখলাম অফিসারের গলার স্বর নিচু।বললাম সোহেল নামে একজন বাংলাদেশির খোজ নিতে এসেছি। । অফিসার জানতে চাইলো আমি তাকে দেখলে চিনতে পারবো কি না? আমি বললাম, তাকে সরাসরি না দেখলেও ছবি দেখেছি। লক্ষ্য করলাম আমাদের সাথে উগ্র মেজাজ দেখাচ্ছে না। কেন আমাদের সাথে মেজাজ গড়ম করছে না সেটাও রহস্যময়। তবে তার চোখে মূখে কোন ইতিবাচক ভাবসাব নেই বললেই চলে। কম্পিউটারে সার্চ করে খুজে বের করতে তার পাসপোর্ট নাম্বার দিতে চাইলাম। তখন অফিসার বললো এখানে এসব দিয়ে লাভ নেই কারণ ডকুমেন্টস জাল হতে পারে। হাজার হাজার বন্দীর থেকে খুজে বের করতে সে কোন দেশের নাগরিক এবং তার নাম এই দুটো তথ্য ই প্রাথমিক ভাবে লাগে। অবশেষে তার কম্পিউটারের মনিটর টি আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললো দেখো চিনতে পার কি না? আমি মনিটর ও আমার মোবাইলে থাকা ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ফ্রিজ হয়ে রইলাম। কারণ ছবির সাথে তার বর্তমান চেহারার কোন মিল নেই। অগ্যতা না চিনেও চেনার ভান করে বন্দীর কোড নাম্বার নিয়ে কাউন্টার থেকে সরে গেলাম। কারণ যদি বেশি সময় নষ্ট করি তাহলে আমার সাথেও গড়ম হয়ে যাবে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত সব স্বাভাবিক আছে। অফিসার সোহেলের ব্যপারে যা বললো তা হলো গ্রেফতারের সময় তার কাছে যে পাসপোর্ট ছিল তার মেয়াদ এবং ভিসা ছিল না। তাই তার বিরুদ্ধে নো পাসপোর্ট মামলা হয়েছে। তাই তার তিন মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলেই ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। সেখানে গেলে দূতাবাসে চিঠি দেওয়া হবে। সে যে বাংলাদেশের নাগরিক তার স্বপক্ষে তথ্য উপাত্ত এবং দেশে ফেরার জন্য বিমানের টিকিট দেওয়ার জন্য। সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে যত তাড়াতাড়ি এই তথ্য সরবরাহ করা হবে তত তাড়াতাড়ি প্রবাসীরা দেশে ফিরতে পারবেন। তবে অনেক সময় বিভিন্ন কারণে দূতাবাস থেকে তথ্য প্রেরনে দেরিও হয়। মালয়েশিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে জনসেবা অত্যান্ত উন্নত মানের। সেখানে সেবা প্রার্থী কে স্যার বলে সম্বোধন করে আন্তরিকতার সাথে সেবা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ানরা এমনিতেই ভদ্র ও শান্ত মনের মানুষ। তারা জোরে কথা বলে না, ঝগড়া করে না। সব সময় ইতিবাচক থাকে। সেই জেলখানায় কেন পাকিস্তানীর সাথে এরকম আচরণ করলো আমাদের কাছে এটা রহস্য ই থেকে গেলো। সোহেলের খবর বাংলাদেশে তার বৃদ্ধা মাকে জানাতে দেরি করলাম না।

চালিয়েছিলাম তাতে সফল হয়ে আমি মনে অনেকটা শান্তি খুজে পেলাম। বন্দী অবস্থায় বিমানের টিকিট কেনার দায়িত্ব ওই বন্দীর উপর ন্যস্ত থাকায় আটককৃতরা তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে পারছেন না। স্বজনদের দাবি, সরকারিভাবে টিকিটের ব্যবস্থা করা হলে আটক বাংলাদেশীরা দ্রুত দেশে ফিরতে পারবেন। তাদের ভোগান্তি কমবে। যাই হোক দেশে থাকা অসহায় বৃদ্ধা মায়ের আকুতিতে তার কথা রাখলাম।বৃদ্ধা মা যে বলেছিল তার ছেলে কে খুজে দিলে কলিজা ভরে দোয়া করবে সেটা করেছে কি না জানি না।তবে তার ছেলেকে খুজে পাওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

আশরাফুল মামুন/বার্তা বাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর