মাসের পর মাস পানিবন্দি গ্রাম, দুর্ভোগ চরমে

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চর বানা। সব ধরণের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রামের মানুষ। কয়েকযুগ ধরে বর্ষা মওসুম এলেই গ্রামের লোকজন বছরের প্রায় ছয় মাস পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এবারও প্রায় তিন মাস যাবত পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তারা। নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সেবার সুবিধা। প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করে কোনমতে টিকে আছেন গ্রামটির সহস্রাধিক মানুষ।

জানা যায়, আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদর হতে গ্রামটির দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার। মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষে গ্রামটির অবস্থান। আয়তনে খুব একটা বড় না হলেও পরিবার রয়েছে ২২০টি এবং লোকসংখ্যা হাজারেরও বেশী।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে গ্রামটির পানিবন্দি মানুষের অভিশপ্ত জীবনযাত্রার চিত্র উঠে আসে ‘বার্তা বাজার’ এর অনুসন্ধানে।

ছবি- বার্তা বাজার।

গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই থই থই পানি। চারপাশে পানি, মাঝখানে বাড়ির ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোন কোন বাড়ির উঠানে ও বসতঘরের ভিতরেও পানি প্রবেশ করেছে। প্রায় সব বাড়িতে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট এখন নিত্যদিনের। বিপর্যস্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও।

জামান মোল্যা ও বেবি বেগম নামে এক দম্পতি বলেন, ‘আমাদের ঘরের মধ্যে পানি উঠে গেছে। ২ সন্তানকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে। ঠিকমতো রান্নাও করতে পারি না।’

গ্রামটির প্রবেশের প্রথমেই একটি ব্রিজ থাকলেও ব্রিজের দু’পাশের সংযোগ রাস্তাটি অতি নিঁচু হওয়ার কারণে প্রায় পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে সড়কবিচ্ছিন্ন ব্রীজটি অকেজো অবস্থায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে নৌকাই গ্রামটির মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা। গ্রাম থেকে অন্যত্র যাওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা নেই।

গোলাম রসুল নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ‘শুনি বাংলাদেশ ডিজিটাল, কিসের ডিজিটাল? মাসের পর মাস আমাদের রাস্তায় পানি থাকে। স্বাধীন দেশে বাস করেও স্বাধীন ভাবে চলতে পারিনা।’

ছবি: বার্তা বাজার।

গ্রামটিতে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের অন্যত্র যেতে হয়। তাই স্কুলগামী শিশু-কিশোররা পানির কারণে ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয় না। অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়ে নৌকাযোগে বিদ্যালয়ে যায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারণে মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে পড়তে হয় মহা বিপাকে।

গ্রামটির মসজিদের ইমাম শেখ ফরিদ জানান, ‘সম্পূর্ণ এলাকাটি পানিতে প্লাবিত হওয়ার কারণে নৌকাযোগে মুসল্লীদের নামাজ পড়তে মসজিদে আসতে হয়। সকালে শিশুরা ঠিকমতো মক্তব পড়তে আসতে পারে না।’

এছাড়া বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি পানির নিচে থাকায় কৃষকেরা ৪ মাস কোনো কাজ করতে পারে না। কৃষক পরিবারগুলোতে চলছে হাহাকার। গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং লালন পালনেও সমস্যা হচ্ছে।

কৃষক মাফুজার শেখ জানান, ‘কয়েকমাস ধরে পানিবন্দি থাকায় আমার ৩টি গরু নিয়ে খুব বিপাকে পড়ছি। সারাক্ষণ গোয়ালঘরে রাখতে হয়। পানিতে সব জায়গা তলিয়ে যাওয়ার কারণে ঘাঁস পাওয়া যায় না। তাই বাজারের কেনা খাবার খাওয়াতে হয়।’

এদিকে কয়েকমাস ধরে গ্রামটির মানুষ পানিবন্দি মানবেতর জীবনযাপন করলেও এখন পর্যন্ত পায়নি কোন সরকারি সহায়তা।

ফজর শেখ নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা জানান, ‘জনপ্রতিনিধিরা শুধু ভোটের সময় হলে আমাদের খোঁজ নেয়। এরপর তাদের আর খোঁজ থাকে না। আমরা কয়েকমাস পানিবন্দি। কিন্তু কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেয় না।’

এবিষয়ে বানা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাজ ইসলাম খোকন বার্তা বাজার’কে বলেন, ‘নিম্নাঞ্চল হওয়ায় প্রতিবছরই এমন পানিবন্দি হয় গ্রামটির মানুষজন। ইতোমধ্যে গ্রামটির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একটি তালিকা তৈরী করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়া হয়েছে।’

আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদ এলাহী বার্তা বাজার’কে জানান, ‘পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একটি তালিকা পেয়েছি। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। সরকারি কোন বরাদ্দ আসলে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে।’ৎ

মিয়া রাকিবুল/বার্তা বাজার/অমি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর