ঘুষ পেলে সবই করেন আখাউড়ার রেল কর্মকর্তা!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে রেলওয়ের লোকোসেডটি। এখানে ঘুষের বিনিময়ে সহকারী ড্রাইভার ৩০ মাস ও কলম্যান ১৮ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত। আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের পাশে লোকোশেডটি অবস্থিত আর এই লোকোশেডকে ঘিরে অনিয়ম দুর্নীতির মহোৎসব চলছে।

লোকোশেডের ইনচার্জের চেয়ারটা যেন টাকা উপার্জনের মূল হাতিয়ার।

এখানে টাকার বিনিময়ে এ.এল.এম(সহকারী লোকো মাস্টার) গুলোকে সাপ্তাহিক ,পাক্ষিক,মাসিক ও বাৎসরিক ভাবে বাড়িতে রেখে তাদের কে নিয়মিত বেতন ,মাইলেজ ভাতা , ও অন্যান্য সরকারি সকল সুযোগ সুবিদা দিয়ে থাকেন লোকোসেডের দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ মোঃ দেলোয়ার হোসেন মিয়া।

জানা যায়,আখাউড়া লোকোশেডে সহকারি ড্রাইভার এইচ এম কামরুজ্জামান (টিকেট নং ২৯২০) তিনি ৩০ মাস যাবত লোকোশেডে অনুপস্থিত ,কলম্যান তাহের অনুপস্থিত প্রায় দেড় বছর,হেড বুকিংক্লার্ক সাজ্জাদ ১৫ দিন সেডে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তী ১৫ দিন অনুপস্থিত থাকেন না। তারপরেও সকলেই বেতন-ভাতা মাইলেজ তুলছেন নিয়মিত,ঘুষের বিনিময়ে।

এছাড়াও করোনাকালীন প্রথম লকডাউনের সময় ২২ জন ও পরবর্তী লকডাউনের সময় ১২ জন ড্রাইভার ও সহকারি ড্রাইভারকে বাড়িতে পাঠিয়ে উপস্থিতি দেখানোর জন্য প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে।

উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে আন্ডারেস্টে বুক না করার নির্দেশ থাকলেও ট্রেন নিয়ে আগত ড্রাইভার ও সহকারি ড্রাইভার দের টি,এম ও শান্টিং এ ৩ থেকে ৪ জন করে বুকিং দেখানো হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে ।

জানা যায়, কোথাও কোন ট্রেন দূর্ঘটনায় শিকার হলে উদ্ধারকারী (রেলিফ) ট্রেনে ৭ থেকে ৮ জন কাজ করলেও অথচ ১৫ থেকে ২০ জন লোক রিলিফ ট্রেনে গিয়েছে দেখিয়ে থাকেন তিনি, যা সংখ্যায় রানিং রুমের সমস্ত কর্মচারীদের দেখানো হয়।তাদের প্রতি বেলার খাবারের বিল ৪০০ টাকা করে আত্মসাৎ করেন বলেও জানা যায় ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া বিরুদ্ধে ।

পথিমধ্যে কোন ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে কন্ট্রোল আদেশ মোতাবেক মেরামত কর্মী পাঠাতে হয়। তিনি একটি কন্ট্রোল অর্ডার এর বিপরীতে একাদিক ভাউচার প্রদান করে থাকেন । প্রতি ভাউচার ১০০ টাকার বিনিময়ে এমন অভিযোগ ও রয়েছে ইনচার্জ মোঃ দেলোয়ার হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে।
টুলম্যানের ডিউটি যে করে তার থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়ে থাকেন তিনি।

এতেই শেষ নয় নিয়ম অনুযায়ী সেট থেকে ইনচার্জ বাহিরে কোথাও গেলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত যেতে পারেন না। তারপরও তিনি বেশির ভাগ সময় বিনানুমতিতে সেটের বাহিরে থাকেন।

জানা যায়, যারা লোকো মাস্টার হিসেবে কাজ করেন তাদেরকে মাইলেজ দেওয়া হয় দুটি নিয়মে ট্রিপ সিস্টেম অথবা আওয়ার সিস্টেমে। নিয়ম অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে মাসে ৩০ দিন,দৈনিক ১২ ঘন্টা ডিউটি করলে মাসে ৪৫ দিন কিন্তু ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন ৬০ দিন ৬৫ দিন ৭০ দিন কিসের বিনিময়ে দেখিয়ে থাকেন তা এই নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

যদিও এই সেডে প্রচলিত আছে মঞ্জুরির চেয়ে লোকবল অনেক কম মঞ্জুরিতে যা ছিল ২৮ টি যাত্রীবাহী গাড়ি ও ৯টি মালবাহী গাড়ি সহ মোট ৩৯ টি গাড়ির বিপরীতে ১৩৩ জন। কিন্তু বর্তমানে গাড়ি আছে যাত্রীবাহী ৮ টি এবং মালবাহী ৩ টি সহ মোট ১১ টি। লোকো মাস্টার(এল এম) এর সঙ্কট আছে জানা যায় তবে সহকারী লোকো মাস্টার( এ এল এম) এর সঙ্কট নেই।কিন্তু ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ভুল বুঝিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে চাপের মধ্যে রাখেন।

ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়ার ঘুষ নেওয়ার চাহিদা এতটাই বেড়ে গেছে যে প্রতিদিন ট্রেন নিয়ে আগত ড্রাইভার ও সরকারী ড্রাইভারদের বাড়িতে রেখে যথারীতি ও যথানিয়মে বুকিং না দেখিয়ে পরের দিন টি, এম,ও এবং রিলিফ ট্রেন সান্টিং এ বুকিং দেখিয়ে থাকেন প্রতিদিন ৩ (তিন)জন এল.এম ৩(তিন)জন এ.এল.এম সহ ১২ জনকে মিথ্যা ডিউটি দেখিয়ে থাকেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা হয় নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক রেলওয়ের একটি সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের সাথে তিনি শুরুতে তথ্য দিতে অসম্মতি জানালেও তার বিরুদ্ধে কেন জয়েন্ট পিটিশন দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন আখাউড়ায় দীর্ঘ ১২ বছর একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। করোনাকালীন সেড ম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি সেই সময় লোকজন ডিউটিতে না আসলে তাদেরকে ফোন দিলে বিরক্তবোধ করতেন তারা ,সে হিসেবে আমি একা ডিউটি করেছি।

তার পরেও একসময় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি সেক্রেটারি থাকাকালীন তাদের সুযোগ-সুবিধা কেন দেয়নি। পরে কয়েকজন কে অনুপস্থিত দেখানো হলে আমাকে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন এবং নি:স্বর্থ ক্ষমা চাইতে হয় এতেও ক্ষুভ মেটে নাই তাদের। তারপর ৪৫ জন রানিং স্টাফ লেলিয়ে দিয়ে জয়েন্ট পিটিশন করানো হয় আমার বিরুদ্ধে । যা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়।এতে আমি ঢাকা লোকোশেডে যেতে বাধ্য হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্টাফ এর কাছে অনিয়ম দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান আখাউড়া লোকোসেডের ইনচার্জ রেল টা এমন ভাবে চালায় যে তার অনেক টাকার প্রয়োজন টাকা লাগবে।

আরো জানা যায়,ইনচার্জ দেলোয়ার হোসন করোনা প্রথম ধাপে ২২ জন ও দ্বিতীয় লকডাউনে ১২ জন স্টাফকে বাড়িতে রেখে প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন এর সাথে বুকিং ক্লার্ক সাজ্জাদ ও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়( এ,এল,এম) এইচ এম কামরুজ্জামান লোকোসেটে দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থেকে তারা গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে তিনি সেখানে ইট ভাটার ব্যবসা,স্কুলের ব্যবসা সহ বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত। তার ইট ভাটার ব্যবসায় ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে শেয়ার ছিলেন বলেও জানা যায় ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া।

এ বিষয়ে জানার জন্য এইচ এম কামরুজ্জামান এর সাথে যোগাযোগ করার জন্য বারবার ফোন দেওয়া হলেও সে ফোন রিসিভ করেননি ।

এ বিষয়ে কলম্যান আবু তাহের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, আমি তিনদিন পাঁচদিন ছুটি কাটিয়েছি এখনো ছুটিতে রয়েছি। দেড় বছরের মধ্যে বেশিরভাগই ছুটি কাটিয়েছেন বলে জানান তিনি। ২০ তারিখে সেডে এসে ২৮ তারিখ চলে যান এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান ছুটি ছাড়া একদিন ও আমি বাড়িতে যাই নাই আপনি আমার হাজিরা খাতা‌ দেখেতে পারেন। আমি ছুটি ছাড়া বাড়িতে যায় না।

হেড বুকিংক্লার্ক সাজ্জাদুর রহমানের কাছে (এ এল এম) এইচএম কামরুজ্জামান ও কলম্যান তাহেরকে টাকার বিনিময়ে বাড়িতে রেখে উপস্থিতি দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। এ ব্যাপারে ইনচার্জ স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।

উপস্থিতি দেখানোর জন্য ইনচার্জ তাকে চাপ প্রয়োগ করেছেন কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি কারোও না কারও অধীনে চাকরি করি আমার জবাবদিহি আছে আমি স্যারের অধীনে চাকরি করি স্যার আমাকে যা আদেশ করে আমি তাই করি। আমি তৃতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী।

এই সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আখাউড়া লোকোসেডের ইনচার্জ মো: দেলোয়ার হোসেন মিয়া বলেন (এ এল এ কামরুজ্জামানের ছুটি অনেকদিন অনুপস্থিত ছিল।

আবার ডিউটি অর্ডার হয়, আবার চাকরি করেন আবার অ্যাবসেন্ট হয়, কিছু স্টাফ এরকম আছে। কামরুজ্জামান এক মাস দুই মাস এমনকি ৬ মাস ও অ্যাবসেন্ট হয়েছে।

এতবার অ্যাবসেন্ড করার পরে তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন জানান কামরুজ্জামানকে অনেকবার শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

কলম্যান তাহের দেড় বছর যাবত অনুপস্থিত কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান সে এখন ডিউটি করছেন। কলম্যান তাহের ২০ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ সেডে উপস্থিত থেকে ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত বাড়িতে থাকেন কিভাবে জানতে চাওয়া হলে ইনচার্জ কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

ড্রাইভার ও সরকারি ড্রাইভার দের বাড়িতে রেখে টাকার বিনিময়ে উপস্থিতি দেখানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া জানান টাকা নেওয়ার বিষয়টা সত্যি না। দু একজন অনুপস্থিত আছে মিথ্যা না। অফিসে আমি তো একা না যারা মেইনটেন করে যারা হাজিরা দেন লকডাউনে যেখানে যে আটকা পড়েছে করোনার কারণে অনেকে আসতে পারে নাই সমস্যা ছিল অথবা কারোর করোনা উপসর্গ ছিল।

এইচ এম কামরুজ্জামান এর সাথে ইট ভাটার ব্যবসায় শেয়ার আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান ব্যবসা অনেকের থাকে নিজে করে অথবা তার ভাই করে। ইট ভাটার ব্যবসায় ৫ লক্ষ টাকা শেয়ার ক্রয়ের কথাটি ভুল বলে জানান তিনি।

প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ দিন টি এ ভাতা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া জানান তা সত্য নয় যদি এক্সিডেন্ট বা দূর্ঘটনা ঘটে রিলিফ ট্রেন চারদিন পাঁচদিন সাতদিন আট দিন যেতে হয়। তারপরে ইঞ্জিন ফেল করলেও অ্যাটেন্ড করতে হয় সেখানে তাছাড়া কিছু না। ওইভাবে বাইরে যাওয়া হয়না।আন্ডার রেস্টে বুকিং এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন লোক কম থাকায় আন্ডার রেস্টে সুবিধা পাচ্ছে।

ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি সত্যি না বলে তিনি জানান,আন্ডাররেস্টে রানিং স্টাফগন কাজ না করলে আমার কোন ক্ষমতা নাই। আইনের বাইরে কিছু করার রেল ব্রিটিশ আইনে এখনো চলছে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া সম্ভব নয়। আইনের বাইরে কোনো সুযোগ দেওয়ার নাই আইনের মধ্যে থেকে যতটুকু পারি সুযোগ দিয়ে থাকে।

মাইলেজের ক্ষত্রে প্রতিমাসে ৬৫ থেকে ৭০ দিন দেয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান সেটা লোকজন কম থাকার কারণে এমনটা হয় লোক মাত্র ১২ জন। রিলিফ ট্রেনে ৭২ জন সেকশন ব্যাপারটা বুঝানো কঠিন আন্ডারেস্ট জরুরি ৬ ঘন্টা রেস্টে বুকিং করা যাবে রিলিফ ট্রেন হলে ৬ ঘন্টা কম হলে নিতে পারেন আবার মালগাড়ি হলে।

এ সময় হাজিরাখাতা,অন ডিউটি অফ ডিউটিশিট মাইলেজ সামারি শিট চাওয়া হলে ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন মিয়া দেখাতে অসম্মতি জানান

এ বিষয়ে (সি.এম.ই) চট্টগ্রাম প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী বোরহান উদ্দিন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি নতুন জয়েন করেছি আমি বিষয়টা দেখছি।

(ডি এম ই) ঢাকা বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী রেজাউল আলম সিদ্দিকী জানান, এদের ডিপার্টমেন্টে প্রসিডিউর নেওয়া হচ্ছে কামরুজ্জামানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। তাহেরের বিষয়টি ফাইল দেখতে হবে নাম সব মনে থাকেনা অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আমরা এই বিষয়ে দেখব।

হাসান মাহমুদ পারভেজ/বার্তা বাজার/টি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর