ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নে বড় কুশিয়ারা মৌজার মাথুলিয়া গ্রামে কাইজেন কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষকদেরকে ফাঁদে ফেলে কৃষি জমি ধ্বংসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টা কৃষকদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করলেন কাইজেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদ।
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকশ’ নারী-পুরুষ হাউজিং কোম্পানীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান সমৃদ্ধ একটি ব্যানার নিয়ে অপেক্ষমান। এসময় স্থানীয় কৃষক আফসার আলী অভিযোগ করে বলেন, কাইজেন গ্রুপের মালিক তৌহিদ সাহেব প্রথমে কৌশলে বড় কুশিয়ারা, মাথুলিয়া, সীতি, সাছনা এবং মামুরিয়া মৌজার বেশ কিছু কৃষি জমি কিনে নেন।
এরপর তার ক্রয় করা জমিতে ভেকু ব্যবহার করে চারটি বড় বাঁধ তৈরী করেন। এর ফলে ওই সব বাঁধের কারণে আমাদের কৃষি জমির পানি নিস্কাশণ ব্যবস্থা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও তার জায়গায় বাঁধ তৈরী করার কারণে বাঁধের জন্য অতিরিক্ত গভীর করায় বাঁধ সংলগ্ন আমাদের কৃষি জমি ভেঙ্গে পড়ছে।
এসময় তিনি আরও অভিযোগ করেন, এই ছয়টি মৌজার বেশ কিছু জায়গায় তৌহিদ সাহেবের হাউজিং এর জমি থাকায় আমরা আমাদের জমিতে কাজে যেতে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছি, আমাদের জমিতে পানি জমি থেকে ফসল পঁচে যাচ্ছে। এছাড়া আমরা আমাদের ফসল নিয়ে ফেরার পথেও হাইজিং এর জমি থাকায় ফিরতে কোম্পানির পক্ষ থেকে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছি। মোট কথা কাইজেন গ্রুপ আমাদের বাপ দাদার রেখে যাওয়া একমাত্র সম্বল কৃষি জমি কৌশলে গ্রাস করায় এখন আমাদের না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে।
এই ছয়টি মৌজার কৃষি জমিতে বংশী নদী থেকে সেচের জন্য পানি সরবরাহের প্রোজেক্টের ব্যবস্থাপক আব্দুল হালিম জানান, এখানে হাউজিং কোম্পানী কিছু জায়গা কিনে নিয়ে বাঁধ বানাবার ফলে আমাদের সেচ প্রোজেক্ট বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা নদী থেকে পানি এনে নালা কেটে জমিতে যে পানি দিচ্ছি, সেই পানি এই বাঁধের সামনে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। এর ফলে সব জমিতে পানিও যেতে পারছে না এবং জমিতে পানি জমে থাকায় ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এখানকার কৃষকরা তাদের একমাত্র আয়ের পথ এই কৃষিকাজ করতে পারছে না।
এসময় উপস্থিত বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ কাইজেন গ্রুপের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ জানান। অশীতিপর এক হিন্দু নারী বলেন, এ জায়গায় হাউজিং কোম্পানী বালি ফেলে কৃষি জমি ভরাট করছে, এজন্য আমাদের জমি নষ্ট হচ্ছে। তিনি গণমাধ্যমের দ্বারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট কৃষি জমি ধ্বংস করে হাউজিং কোম্পানী বানাবার বিরুদ্ধে সহায়তা চেয়ে বলেন, ‘আমরা তো কৃষি কাজ ছাড়া আর কিছু পারি না, এই জমিই না থাকলে আমরা বাঁচব কিভাবে?’
সরেজমিন বাঁধ গুলিতে যেয়ে দেখা যায়, বাঁধের সাথের কৃষি জমিতে জমে থাকা পানির কারণে ধানের গোড়া পঁচে গেছে। আর গভীর করে ভেকু দিয়ে মাটি কাটার কারণে কৃষকদের জমির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে কোম্পানীর জায়গায় পড়ছে।
কৃষকদের পক্ষে মোঃ আনসার আলী জানান, ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট তারা কৃষি জমি রক্ষার জন্য লিখিত আবেদন করেছেন। এছাড়াও ধামরাই সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ নাহিদ হাসান বরাবর লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। ধামরাই থানার অফিসার ইন-চার্জ দীপক চন্দ্র’র নিকট কাইজেন গ্রুপের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে কৃষক আনসার আলী অভিযোগ করেন, কাইজেন গ্রুপের মালিক তৌহিদ সাহেব নিজের ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) নিজের লোক দিয়ে পুড়িয়ে থানায় আমাদের কয়েকজনের নাম দিয়ে মামলা করেছেন। এজন্য আমাদের পুরুষদেরকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে মিথ্যা মামলার ভয়ে।
আরেকজন কৃষক মো. ইদ্রিস আলী অভিযোগ করেন, কাইজেন গ্রুপের মালিক তৌহিদ সাহেব এই এলাকায় জোর-জুলুম করে হাউজিং ব্যবসা প্রস্তুত করছেন। আমরা বাঁধা দিতে গেলে আমাদেরকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমাদের প্রাণনাশের হুমকী সহ পুলিশ প্রশাসনের ভয় দেখান।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে কাইজেন গ্রুপের মালিক মো. তৌহিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন কৃষকদের বিরুদ্ধে। প্রথমত অভিযোগ করেন আনসার আলী সহ কৃষকদেরকে হাউজিং কোম্পানীর বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে। তিনি জানান, এরাই প্রথমে তার কাছে এখানে কোম্পানী করতে হলে ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা চাইতে আসে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে এরাই এখন নেতৃত্ব দিয়ে সাধারণ কৃষকদেরকে হাউজিং কোম্পানীর বিরুদ্ধে সংগঠিত করছে।
তিনি এসময় স্থানীয় কৃষকদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ করেন, এ পর্যন্ত কোম্পানি প্রায় ৭ শত প্লট বিক্রী করেছেন। এখন প্লট ক্রয় করা মালিকেরা তাদের জায়গায় যেতে পারছেন না কৃষকদের বাঁধার কারণে। পথের মাঝে নারী সদস্যরা দাঁড়িয়ে থাকায় বিব্রত বোধ করে ফিরে যেতে বাধ্য হন প্লটের মালিকেরা। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখানের কোনো কৃষকের জমি জোর করে দখল করা হয় নাই; বরং আশুলিয়ার কলমা, সিন্দুরিয়া এলাকার মালিকেরা স্বেচ্ছায় তাদের জমি কোম্পানীর নিকট বিক্রী করেছেন। তাহলে আমি জোর করে কৃষি জমি দখল করলাম কীভাবে?
কৃষি জমিতে পানি নিস্কাশণের সমস্যার কারণে ফসল পঁচে যাওয়া সহ বাঁধের কারণে সেচের পানি সরবরাহে সৃষ্ট সমস্যার ব্যাপারে কাইজেন গ্রুপের মালিক মো. তৌহিদ জানান, জমিতে সেচের পানি যাওয়া এবং জমিতে জমে থাকা পানি সরানোর জন্য প্রয়োজনে কালভার্ট করে দেবো। কিন্তু তারা (আন্দোলনরত কৃষকরা) তো আমাদের সাথে বসে আলোচনাই করতে চায় না। কয়েকবার বসার জন্য তারিখ দেয়া হলেও তারা আসে নাই।
মো. তৌহিদের চাঁদা দাবীর অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে আন্দোলনরত কৃষকদের নেতা আনসার আলী তা মিথ্যা বলে অভিযোগ অস্বীকার করেন। আর কোম্পানির সাথে আলোচনায় বসার বিষয়ে তিনি জানান, বসার বিষয়ে কাইজেন গ্রুপ নিজেরাই তারিখ দিয়ে আমাদের সাথে বসে নাই।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কালামের মুঠোফোনে কৃষকদের কৃষি জমি রক্ষার জন্য লিখিত আবেদনের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চেয়ে কল করা হলেও তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে কিছু জানা যায় নাই।
ধামরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নাহিদ হাসানের মুঠোফোনে কল করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিক এই মুহুর্তে বলতে পারছি না, বিষয়টি সম্পর্কে দেখে জানাতে পারবো।
ধামরাই থানার অফিসার ইন-চার্জ দীপক চন্দ্র সাহার মুঠোফোনে কৃষকদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একটি জরুরী মিটিং এ আছেন উল্লেখ করে বলেন, লিখিত অভিযোগ হলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।