নাফ নদীতে দীর্ঘ মেয়াদী মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা একটি মৌলিক অধিকার লঙন

দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত টেকনাফ জনপদ, পূর্বে নাফ নদী পশ্চিমে বঙ্গোবসাগর এবং মাঝখানে বিস্তৃত পাহাড়। জীবিকা অর্জনের তিনটি উৎস নিয়ে একটি জনপদ গঠিত। পৃথিবীর এমন জনপদ খুজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ একসাথে জীবিকা অর্জনের তিনটি উৎস নিয়ে খুবই কম জনপদ সৃষ্টি হয়েছে ।

উদাহারণ হিসাবে বলতে পারি আজকে যদি মিশরীয় সভ্যতার কথা চিন্তা করি মিশরীয় সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল নীল নদের উপর ভিত্তি করে। রোমান সভ্যতা গড়ে ওঠেছে রোম নদীর উপর দিয়ে। সিন্ধু সভ্যতা গড়ে ওঠেছে সিন্ধু নদীর অববাহিকায়। সুতরাং তিনটি জীবিকা উপার্জনের উৎস নিয়ে একটি জনপদ কম সৃষ্টি হয়েছে।

টেকনাফের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস হচ্ছে মৎস্য আহরণ আর কৃষি। মৎস্য আহরণ হয় নাফ এবং পশ্চিমের বঙ্গোপসাগর থেকে। কিন্ত অপ্রিয় হলেও সত্য যে ২০১৮ সালে সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং ইয়াবা চালান ঠেকাতে হঠাৎ নাফ নদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা অরোপ করে।

যাহা অত্যান্ত অমানবিক। যদিও মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ ও চিংড়ি আহরণ নিষিদ্ধ।

তবে এ কথা সত্য যে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকলে মৎস্যভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। এর সুফলও মৎস্যজীবীরা ভোগ করবেন। কিন্তু নাফ নদীতে দীর্ঘ মেয়াদি নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলে পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও কিছু সংখ্যক জেলে সে ভাতার মুখ দেখেন। আরও অধিকাংশ জেলে বছরের পর বছর ধরে ভাতা বঞ্চিত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্হানীয় এক জনপ্রতিনিধির তথ্য মতে সাগরে ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য প্রায় ২১০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দরিদ্র ওই জেলেদের মাঝে বরাদ্দকৃত চাল বণ্টন করা হয়।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে চাউল কি আমার মৌলিক চাহিদার সবটি নাকি মৌলিক চাহিদার একটি? সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আমার মৌলিক চাহিদা ৫টি। এর মধ্যে চাউল একটির পর্যায়ে পড়েনা। ধরে নিলাম চাউল মৌলিক চাহিদার একটি। আর বাকি চারটি পূরণ করবে কে?

এই ভাবে বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলেরা বেকার থাকলে তাঁরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তা পোষাতে সরকারের ভূমিকা কী থাকবে, সেটাও ভাবতে হবে।তাছাড়া পেশা বন্ধ হওয়ার কারণে অনেক জেলে পরিবার অভাব অনটনে মৃত্যু সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ব্যাক্তির জীবন ও পেশার অধিকার খর্বের সামিল।

কারণ জীবন ও জীবিকা সংবিধানে তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যাক ব্যক্তির জীবন ও ব্যাক্তির স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে জীবনের স্বাধীনতা কথাটি ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন মামলা ব্যাখ্যা করেছে এবং ব্যাক্তির জীবনের স্বাধীনতা মানে হচ্ছে জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা কিংবা পেশার স্বাধীনতা। কারন ব্যাক্তির জীবনের স্বাধীনতা শব্দটি ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন মামলা ব্যাখ্যা করেছে।

যেমন: ব্যাক্তির জীবনের অধিকার শব্দটি ব্যখ্যা প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি ফিল্ড মুন বনাম ইলিনয় মামলায় বলেন, something more than mere animal existence. The inhibitions against It’s deprivation extends to all those limbs and faculties by which life is enjoyed. The provisions equally prohibits the mutilation of the body by the amputation of an arms or legs or the putting out of eyes, or the destruction of any others organ of the body Through which the soul communicates with the outer world .

বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ব্যাক্তির জীবন ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। কিন্ত এই জীবনের অধিকার ব্যাপক ভাবে ব্যাখ্যা করেছে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৮০ র দশকে জীবনের অধিকার কথাটি ব্যাখ্যায় ভারতীয় বিচারকগণ আরও একধাপ এগিয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন।ভারতের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয় ” No person shall be deprived of his life or personal liberty except according to procedure by law এই অনুচ্ছেদে কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত একটি মামলায় ফ্রান্সিস কোরেলি বনাম ইউনিয়ন টেরিটোরি অব দিল্লি মামলায় প্রশ্ন তুলেন জীবনের অধিকার কি শুধু দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গ রক্ষার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নাকি এর ব্যাখ্যায় আরো কিছু অন্যভূক্ত করার সুযোগ আছে?

এই মামলায় জীবনের অধিকার বলতে ব্যাখ্যা করেন, we think that the right to life included the right to life with human dignity and all that goes along with it,namely, the bare necessity of life such as adequate nutrition, clothing and shelter over the head and facilities for reading, writing and expressing oneself in diverse forms, freely moving about and mixing and commingling with fellow human beings.

অর্থাৎ জীবনের অধিকার হচ্ছে মানবীয় মর্যাদা সহ বেচে থাকার অধিকার, বেচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় যে সব চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন সেগুলো পূরণ করার অধিকার এবং যদি অন্য কোন ব্যক্তি অন্যায় ভাবে যে সব আইন সম্মত চাহিদা পূরণে বিঘ্ন সৃষ্টি হলেই জীবন দুর্বিষহ হলে ওঠে, ফলে জীবনের অধিকার স্বাভাবিক বাধাগ্রস্থ হয়।তাছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৪০ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যাক ব্যাক্তির বৈধ পেশার অধিকার রয়েছে।

মাছ ধরার ব্যাক্তির জীবনের একটি পেশা। এবং যে পেশার উপর ভিত্তি করে জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করে এবং জীবন ধারণ করে।।ব্যাক্তির জীবন এবং পেশার অধিকার মূলত মৌলিক অধিকার। যে অধিকার খর্ব করার ক্ষমতা আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬/৪৪ /৭ অনুসারে কাউকে দেননি।নাফ নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিনদিন আমাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।কারণ এখানে আমার উপরের লেখা অনুসারে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ব্যাক্তির জীবন ও পেশার স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।যাহা দেশের মৌলিক আইন কখনো সমর্থন করেনা।

তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে কোন জনপ্রতিনিধি এই সব সমস্যা নিয়ে কথা বলেনা। তাই আমি প্রশাসনসহ সর্ব স্তরের সবাইকে অনুরোধ করবো নাফ নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিন। এতে করে দেশ সমাজ এবং এলাকায় দারিদ্র্য জেলেরা অভাব অনটন থেকে মুক্তি পাবে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে ও মৌলিক অধিকার সমুন্নত থাকবে, ফলে আইনের সুশাসনের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হবে।

আইনজীবী, চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জর্জ আদালত।

বার্তা বাজার/টি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর