করোনার নিষেধাজ্ঞা, নাকি নিষেধ করার একান্ত আজ্ঞা

করোনা মোকাবেলায় সরকারী ব্যবস্থাপনা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার পাশাপাশি হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরীর দাবীদার। কারণ, গণমানুষ যে দূর্ভোগে আছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ কেবল আমিই না বরং সচেতন যে কারোই থাকার কথা না।

লক্ষ্য করুন, যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশী চক্ষুশূল হয়ে দৃষ্ট হচ্ছে তার মধ্যে প্রান্তিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি অব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশী দৃশ্যমান। ঢাকায় উত্তর এবং দক্ষিণে কেবল শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। যাদের কেউই জানে না আগামীকাল থেকে কঠোর লকডাউন চলাকালীন সময় অবধি যে নিষ্ঠুর দিনগুলো অতিবাহিত হবে, তার জৈবিক জোগান কিভাবে মিটবে? খাদ্য, পানীয়, আবাস তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন চাহিদা। এই সামান্য চাহিদার জোগান টানতে যারা এমনিতেই নাজেহাল, তাদের অনাগত দিনগুলো কেমন কাটতে যাচ্ছে সেটা হয়তো চোখ বন্ধ করে দুঃস্বপ্নের মতো ভাবা যায়। কিন্তু সেখানে অংশগ্রহন করা যায় না।

সমাজের গুটি কয়েক মানুষ, এই পরিস্থিতিতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তা কেবল মাত্র আত্মপ্রচারের জন্যই মূখ্য। অথচ সামাজিক মূল্যবোধের জায়গায় সবাইকে এক কাতারে সমবেতভাবে অংশগ্রহন করতে দেখা যায় না। এটা সবাই জানে, এই ব্যাধি কিংবা ক্রান্তি মোকাবেলা কেবল সমবেতভাবেই সম্ভব। অথচ আমরা এখনো বিস্তারিত জানিনা রাষ্ট্র কি কি ব্যবস্থাপনা রেখেছে বর্তমান ক্রান্তি থেকে জাতিকে মুক্ত করে আনতে।

আজকে সকালের মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক যে প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে তা দেখে যে কোনো মানুষই দ্বিধায় ভুগবে তা বলা বাহুল্য। কারণ, রাষ্ট্র কেবল মাত্র তাদেরকে বিধি নিষেধের আওতার বাইরে রেখেছে, যারা সবচেয়ে বেশি শক্তি দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণ সরূপ বলতে হয়, তৈরী পোষাকখাত পুরো করোনা সময়কাল ধরেই আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত ছিলো। সবচেয়ে বেশী পোশাক শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর চাপ পাশাপাশি বৈদেশিক বাজারে নিজের অস্তিত্ব সমুন্নত রেখে মূদ্রা আহরনের চাপ করোনা পরিস্থিতিতে যে একটি চ্যালেঞ্জ তা মোটা দাগে না বললেও সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে, রাষ্ট্র অবশ্যই একটা বিশেষ শিল্পকে বিশেষায়িত সেবা প্রদান করতে বাধ্য হতে পারে না।

সবচেয়ে বেশী যে ব্যবস্থাপনাগুলো হতাশ করেছে, তার মধ্যে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার কথা না বললেই নয়। গ্রামীণ প্রান্তিক জনগনের কথা বাদ দিলাম, সাধারণ শহুরে জনগনের মধ্যে কয়জন জানে যে, ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিলেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী অথবা দ্বায়িত্বশীল কেউ একজন হাজির হয়ে যাবে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে। তারচেয়ে আমার সবচেয়ে বেশী যে বিষয়গুলো জানার আগ্রহ তা হচ্ছে, কোন অঞ্চলে কি পরিমান ত্রাণ প্রয়োজন হতে পারে, কতজন মানুষ স্বাভাবিক জীবন ধারার বাইরে নিম্নবিত্ত জীবনধারায় সম্পৃক্ত তার আদৌ কোন শক্ত তথ্য কিংবা তালিকা কি ত্রাণ ও দূর্যোগ মন্ত্রনালয়ের জানা আছে?

আশাকরি যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবারো পূর্বের ন্যায় চোখ ফিরিয়ে এড়িয়ে যাবেন। অথবা প্রশ্ন করা মাত্রই মুখস্ত বিদ্যার অভ্যস্ততা নিয়ে বলে উঠবেন, “এ ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছি, শীঘ্রই সাধারণ মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে”। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জবাবদিহিতা নামক শব্দের এমন বিবর্ণ প্রতি উত্তরের জবাবদিহিতা কবে চাওয়া হবে? কে আছে এমন, যে সরিষার ভেতর থেকে ভূত তাড়াতে সক্ষম?

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে জানালেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসসমূহ করোনা টিকা কার্যক্রম সম্পাদনের পরই খুলে দেয়া হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্দ্যেগ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে, যারা শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে জড়িত, তাদের উপায় টা কি? একজন শ্রেণী শিক্ষক, যিনি পাঠদান করেন পাশাপাশি টিউশন দিয়ে থাকেন ব্যাক্তিগত উপার্জনের নিমিত্ত্বে, তার পক্ষে কি আদৌ ত্রাণ চেয়ে রাস্তায় সারিবদ্ধ ভাবে সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে দাড়ানো সম্ভব? তাহলে একজন শিক্ষকের আত্মসম্মান বোধ এবং আত্নমর্যাদা বোধ আমরা কিভাবে রক্ষা করলাম?

এমন ভাবে বলতে শুরু করলে হয়তো প্রতিটা খাত নিয়ে বলা যাবে। আমি সবকিছু ছাপিয়ে কেবল একজনকে নিয়ে বলতে চাই। যার কাছে সবাই আকাঙ্ক্ষা করে, বিচার প্রার্থনা করে, সাহায্য প্রার্থনা করে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দ্বায়িত্বশীল যারা রয়েছেন তাদের কাছে চাওয়া এবং নিজের অধিকার বুঝে পাওয়ার যে নাগরিক রীতি আছে, আমরা কি ধীরে ধীরে সেই চর্চা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি? এভাবে চলতে শুরু করলে হয়তো শৃঙ্খলায় নিয়োজিত যারা রয়েছেন তারাই একদিন বলে বসবেন, আজ থেকে সাধারণ ডায়েরী কিংবা অভিযোগ লেখা সমাপ্তি। অনুগ্রহ পূর্বক মাননীয়কে অবহিত করুন।

এটা কি চুড়ান্ত পর্যায়ের খামখেয়ালীপনা নয়? একজন দায়িত্বশীলকে এড়িয়ে যখন কেউ তার ব্যাক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত অথবা অভিযোগ করেন, তখন দ্বায়িত্বশীল ব্যাক্তির ভূমিকা কোথায় থাকে? এসব প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে গিয়ে বারবার বাঁধার সম্মুখীন হওয়া এমন অনেক ব্যক্তিকেই দেখেছি নিজের মলিন চেহারা অন্ধকারে লুকিয়ে ফেলতে। আমরা তবে কিসের স্রোতে ভাসছি? তার কোনো সঠিক সমীকরণ কেউ বলতে পারেবেন কি?

দেশে লকডাউন হোক, শাটডাউন হোক আপত্তি নেই। তবে আমার ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকলে অবশ্যই আমার আপত্তি আছে। আমি যেমন সংকট নিরসনে চুপ করে ঘরে বসে থাকবো, তেমনি সরকারের উচিত চুপ করে এসে, অন্যের অগোচরে আমার ঘরে খাবার পৌছে দেয়া। আমি যেমন রাস্তায় চলাচল থেকে বিরত থাকবো, তেমনি সরকারের উচিত গণপরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর ঘরে অন্তত খাদ্য নিশ্চিত করা। অল্প কয়েকদিন পরই জাতীয় নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনে যদি মনোনীত প্রার্থী সকল নির্বাচনী প্রচারণার নামে কোটি কোটি টাকার অর্থ ব্যয় করতে পারে, তাহলে সংকট মুহুর্তে ক্রান্তির চুড়ান্ত লগ্নে ভোটের ক্যাম্পেইনের চা-নাস্তার খরচ কিংবা প্রচারনা খরচ গুলো ত্রাণ হিসেবে কেন ব্যায় করতে পারবে না?

জনগন মানে কেবল ভোট দেয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র না। জনগন মানে দেশের স্বত্ত্বাধিকারী। দেশের ভালো এবং মন্দের একান্ত ভাগীদার। দেশের উন্নয়ন কিংবা ক্ষতির একমাত্র দায়গ্রস্থ ব্যক্তি। তাই আবারও যথাযথ কর্তৃপক্ষ নামক আংশিকদের প্রতি আহ্বান করছি। নিষেধাজ্ঞা থাকুক, সেই সাথে থাকুক সঠিক ব্যবস্থাপনা। কোলাহল মুক্ত থাকুক জনজীবন, সেই সাথে থাকুক নাগরিক নিরাপত্তা ও সেবার সঠিক নিশ্চয়তা।

বার্তা বাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর