ছয় মাসেই বাড়ল ১৬ হাজার কোটি টাকা

অর্থবছরের শুরুতে বেড়েছে শূন্যশুল্কে পণ্য আমদানি। মাত্র ৬ মাসেই তা বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি।
অর্থ পাচারের শঙ্কা * ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

অথচ যেসব পণ্য ‘আমদানি হয়েছে’ বাস্তবে দেশে ওই ধরনের পণ্যের চাহিদা কমেছে। অর্থনীতিবিদরা তাই এর আড়ালে অর্থ পাচারের শঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, এ ধরনের পণ্যের আড়ালেই সাধারণত অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসে। এছাড়া বেশ কিছু অভিযোগ মিলেছে, আমদানি বা রফতানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পর কোনো পণ্য বিনিময় না করেই বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছে চক্র।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই যে পদ্ধতিতে বেশি অর্থ পাচার হয় তার অন্যতম হল ট্রেড (আমদানি-রফতানি)।

তবে আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে যাতে এভাবে পাচার ঠেকানো যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এলসি খোলা থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সব কাজে নজরদারি করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরপরও সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য থাকলে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত যেসব পণ্যে কম শুল্ক থাকে, ওই পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হয়। কারণ সরকারকে কোনো ধরনের রাজস্ব না দিয়েই টাকা নেয়া যায়। তিনি বলেন, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বিষয়টি চলে এসেছে। ফলে সরকারের অবশ্যই তদন্ত করা উচিত।

বর্তমানে ৩২৮ ধরনের পণ্য আমদানি করতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। এর অধিকাংশই খাদ্যপণ্য। এর মধ্যে চাল, ডাল, আটা, ময়দাসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্য রয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার কথা বিবেচনা করে এসব পণ্যে সরকার শূন্যশুল্ক সুবিধা দিয়েছে।

কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শূন্যশুল্কে ৮১ হাজার ২৬২ কোটি টাকার পণ্য এসেছে। আগের বছর যা ছিল ৬৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে পণ্য আমদানি বেড়েছে ১৫ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে যা ২৪ শতাংশ বেশি। অথচ আলোচ্য সময়ে সার্বিক আমদানি বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হঠাৎ করে এ ধরনের পণ্য আমদানির বিষয়টি রহস্যজনক। কারণ বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনো কোনো খাদ্য রফতানির কথা ভাবা হচ্ছে। এরপরও আমদানি বাড়ার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কাগজে-কলমে পণ্য আমদানি দেখানো হলেও বাস্তবে ওই পণ্য আসছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। টাকা পরিশোধ করার পরও পণ্য হস্তান্তর না করার কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছে। এর অন্যতম হল ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারি।

গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে ১৪ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে দশমিক ৩১ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ, এ শুল্ক দিয়ে ১ হাজার ১৭৭ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করা যায়। আর ৬৬২ ধরনের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নির্বাচনকালে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ না করার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। এ সময় শিল্পের উৎপাদনও কমেছে। অথচ রহস্যজনকভাবে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। যেখানে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, সেখানে কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

অন্যদিকে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত পণ্য আমদানির পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধি কমেছে। ৩ হাজার ২০৩ ধরনের পণ্য আমদানিতে এ শুল্ক দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে কসমেটিক্স, বাদাম জাতীয় পণ্য, তাজা-শুকনা ফলমূল, চা-কফি, মসলা জাতীয় পণ্য, পাস্তা, রুটি-বিস্কুট, জ্যাম-জেলি, সস-স্যুপ ইত্যাদি। কাস্টমসের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এ থেকে শুল্ক আদায় হয়েছে ২৮ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। গত বছর পণ্য আমদানি হয়েছিল ১ কোটি ৮১ লাখ ৭০ কোটি টাকার।

দেশে এখন আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির হার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে আমদানি ব্যয় ছিল ৫৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রফতানি আয় ছিল ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিটেন্স এসেছে ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।

রফতানি ও রেমিটেন্স মিলিয়ে মোট এসেছে ৫১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে রফতানি ও রেমিটেন্স মিলিয়েও আমদানি ব্যয় রফতানি ব্যয়ের চেয়ে ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার কম। অর্থাৎ দেশে যে হারে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এটি অস্বাভাবিক। গত ১০ বছরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, পাচারের কারণেই আমদানি বেড়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী বছরে এলেই টাকা পাচার বাড়ে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যেও একথা বলা হয়েছে। ২০১৮ সাল ছিল নির্বাচনী বছর। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা দেশে রাখাকে নিরাপদ মনে করেন না। সম্পদশালীরা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে। এ কারণে আমদানিসহ অন্যান্য মাধ্যমে পুঁজি পাচার করা হয়।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বড় দুটি সংস্থা বাংলাদেশের জন্য খারাপ বার্তা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর ১০ বছরে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর ৮০ শতাংশ পাচার হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের (আমদানি-রফতানি) আড়ালে। জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। এর আগে সুইস ব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের তৈরি পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে টাকা পাচারের তথ্য মেলে। বাংলাদেশের বড় কয়েকটি গ্রুপ এতে যুক্ত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, পাঁচভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমেই পাচার হচ্ছে বেশি। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো হয় (আন্ডার ইনভয়েসিং)। অর্থাৎ কাস্টমসকে ভুল তথ্য দিয়ে আমদানি-রফতানির প্রকৃত দাম গোপন করা হয়। এক্ষেত্রে যে সব পণ্যে শুল্ক নেই, সে ধরনের পণ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার করা সহজ হয়। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়লে এ নিয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন, সরাসরি ডলার নিয়ে যাওয়া এবং ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।

সম্প্রতি টাকা পাচারের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। আমদানি বা রফতানির এলসি খোলার পর কোনো পণ্য বিনিময় না করেই বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছে চক্র। এক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণসহ সব কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করে ব্যাংকে জমা দেয় তারা। সাধারণত সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তাদের কাগজপত্র যাচাই করে না, এ সুযোগটিই নেয় চক্রটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরীক্ষা করলেই বিষয়টি ধরা সম্ভব হবে। তাদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছা জরুরি।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর