রোহিঙ্গাদের বিষাদের ঈদ

ঈদের দিন বুধবার সকাল ৮টায় কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পশ্চিমে পাহাড়ের পাশে খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় ঈদের নামাজ। প্রায় আড়াইশ’ রোহিঙ্গা অংশ নেয় এই জামাতে। নামাজের মাঝখানেই ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ক্রমেই সংক্রমিত হচ্ছিল সে কান্না। যে দেশে জন্ম, বেড়ে ওঠা, সেই দেশেই ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হওয়া, স্বজন হারানোর বেদনা ঈদের দিনে আরও বেশি ব্যথা হয়ে বাজছিল তাদের বুকে।

কক্সবাজারের ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ১ হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মক্তব) এবং টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০টি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি মসজিদ ও ২০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মক্তব) রয়েছে। এসব মসজিদ ও নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গারা। এছাড়া অনেক রোহিঙ্গা দল বেঁধে খোলা আকাশের নিচে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন।

ঈদের দিন কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখা গেছে, শিশুরা সকাল থেকেই সেজেগুজে, নতুন জামা-কাপড় পরে ক্যাম্পের রাস্তায় হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে ওঠে। রোহিঙ্গা শিশুদের অনেককে নতুন জামা, গেঞ্জি , লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও চশমা পরে দল বেঁধে শিবিরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অনেক শিবিরে বসে নাগরদোলা, চড়কিসহ মিনি মেলা। সেখানে ভিড় করে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোররা। তবে বড়দের স্বজনহারা বিষাদের যন্ত্রনায় কাদঁতে দেখা গেছে।

উখিয়া খোলা আকাশের নিচে পুরনো জামা পরে নামাজে অংশ নেয় মোহাম্মদ আনু নামে এক রোহিঙ্গা শিশু। সে জানায়, ‘এপারে তার কেউ নেই; ওপারেও কেউ নেই। ২০১৭ সালে আগস্টের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের একটি দলের সঙ্গে এপারে পালিয়ে আসে সে। পরিবারের সদস্যরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা জানা নেই। তবে সে পরিবারের খোঁজে মিয়ানমারে যেতে চায়। কিন্তু সেখানে সেনার ভয় আছে বলেও সে ভীত বলে জানিয়েছে।

আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘আজকে ঈদের নামাজ শেষে শুধু ইমাম, মৌলভীরা নয়, মসজিদে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। রাখাইনে আমরা কেউ বাব-মা ও বোনকে হারিয়েছি, আবার কেউ ভাই ও স্বজনকে হারিয়েছি। কবরে পড়ে রয়েছে আমার মা। অন্তত তাদের জন্য হলেও কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ, দুই বছরের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছে আমরা বাংলাদেশে এসেছি। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনও সংস্থা আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’

২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলার জন্য রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরসাকে দায়ী করে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে প্রাায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয। পুরনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সূত্রে মতে, এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে রোহিঙ্গা নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে।

উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের দল নেতা মোহাম্মদ সাদেক বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ায় ঈদের নামাজ খুব ভালো ও সুন্দর পরিবেশে আদায় করেছি। কোনও রোহিঙ্গাকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবে ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার সময় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এইদিনে বাবাকে খুব বেশি মনে পড়ে। এতে খুব বেশি কষ্ট হয়।’

গত দুই মাস আগে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন জাহানার বেগম। একমাত্র ছেলের প্রথম ঈদে নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি। খুবই কষ্ট লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে স্বামী আবদুল হাকিমকে হারিয়ে এপারে এসেছি। ওপারে তার স্বামীর তিনতলা কাঠের বাড়ি ছিল। ছিল তিন একর জমির চিংড়ি ঘের। এখন সব হারিয়ে ঝুপড়ি ঘরে থাকতে হচ্ছে। দুই বছরের কাছকাছি হয়ে যাচ্ছে, জানি না এখনো স্বামী বেঁচে আছে কি-না?’

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশ উখিয়ায় অবস্থান করছে। ঈদে তাদের কথা বিবেচনা করে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে, সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আগে থেকে নেওয়া হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশে সকল রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে।’

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর