বিন্দু থেকে সিন্ধু, এক মহামানবের কথা

শেখ আমিনুর হোসেন, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: আমার যখন একটু বড় শিশুকাল তখন আমি প্রায়ই ফর্সা, সুন্দর, রাজপুত্রের মতো মুখ একজন মানুষকে চিনতাম, চিনতাম না বলে বলতে হয় তাকে প্রায়ই দেখতাম সভা-সমিতি শোভাযাত্রার অগ্রভাগে।

একটু বড় হয়ে বুঝতে শিখলাম সমাজের অলাভ ক্ষেত্রগুলোতে মূলত তাঁর যাতায়াত। ‘বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ প্রবাদটির আর কোনো অর্থ তাই কষ্ট করে আমার বুঝতে হয়নি পরবর্তী শিক্ষা, সমাজ, পারিবারিক জীবনে। জনাব আব্দুল মোতালেব। একজন আলোক মানুষ, নক্ষত্র পুরুষ। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই মাত্র একযুগ আগেও শিক্ষা এবং সামাজিক সংগঠনগুলো এখনকার মতো নষ্টদের অধিকারে যায়নি তখনও।

জনাব আব্দুল মোতালেব তাঁরও কিছুদিন আগে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিক অনগ্রসর সাতক্ষীরার বুকে শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিকতার কিরণ-উত্তাপ তৈরী করতে সরকারি চাকুরীর মোহ ত্যাগ করে পৈত্রিক একটি প্রেসকে আশ্রয় করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণক্ষেত্রে। এই যোদ্ধার যতুগৃহে না ছিলো ধনসম্পদ, না ছিলো লোকবল, না ছিলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।

তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলো অন্ধকারের শক্তি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দরিদ্রতা, বেকারত্ব, নষ্ট সঙ্গ, নষ্ট মানুষদের সহর্ষ চিৎকার শিৎকার ইত্যাদি। তবু তিনি জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর জয়ের মন্ত্র ছিলো সত্যের প্রতি তীব্র অনুরাগ, সাহস, পরোপকারের মানসিকতা, নির্লোভ, শিশুর মতো সরল মন, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা ইত্যাদি। কাজের মধ্যে তিনি প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পেতেন।

এই আনন্দই ছিলো তাঁর জীবন শক্তির দুগ্ধ সলিল উত্তাল প্রবাহ। মোটামুটিভাবে শিক্ষা, সমাজসেবা, সাংবাদিকতা এবং প্রবাহমান সংস্কৃতির উৎকর্ষ অভিঘাতের ভিতরে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে বিলিয়ে দিয়েছিলেন স্বার্থহীন অন্ধ ভালোবাসায়। সেই স্বার্থহীন অন্ধ ভালোবাসা ছিলো মানুষের প্রতি, তাঁর মতোই আলোকিত মানুষ তৈরীর প্রচেষ্টায়। জনাব আব্দুল মোতালেব একজন মানুষ, একটি সংগঠন, এক বিশাল পৃথিবী। পৃথিবী ও সভ্যতার সমান বয়সী একজন ঋষি।

ব্যক্তি আর ব্যক্তিত্বে তিনি কোজাগরী জোছনার মতো উজ্জ্বল, শরতের মতো নির্মল, প্রতুষের রাঙা সূর্যের মতো শুভ্র ও সুন্দরের সন্ধিক্ষণ। অসংকোচে জানাই আজ এই মানুষটির সংস্পর্শে আমার ভিতরে ঘটেছিলো এক আশ্চর্য রূপান্তর। সে কথাই বলবো আজ। একন্তই ব্যক্তিগত হলেও ক্ষতি নেই কোনো। আমি তখন সদ্য এম.এস-সি শেষ করে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় ফিরেছি। বেকারত্বের দহন আমার নেই। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ পিতার সুনাম এবং তাঁরই আশ্রয় প্রশ্রয়ে আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবো তখন পর্যন্ত সেটাই আমার ধ্যান-জ্ঞান।

বিত্তের হাতছানি, সাফল্যের লোভনীয় উপত্যকা, খ্যাতি ও প্রতিপত্তির একাধিক ধাপ ইত্যাদিকে পিছনে ফেলে আমি শিক্ষক হলাম। সেই দীর্ঘ রোডম্যাপের সংক্ষিপ্ত বয়ান এরকম : একদিন সন্ধ্যায় জনাব আব্দুল মোতালেব, যাঁকে আমি চাচা বলে সম্বোধন করতাম তাঁর কাছে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম, উদ্দেশ্য কোনো একটি স্কুল বা কলেজে তার একটা কাজের ব্যবস্থা করা। আমি জানতাম অনেক শিক্ষিত যুবককে তিনি বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো জায়গায় একটা না একটা কাজ জুটিয়ে দিয়ে বেকারত্বের দুঃসহ দহন থেকে মুক্ত করেছেন। দিন দশেকের মধ্যে আমার সেই বন্ধুটি একটি স্কুলে চাকুরী নিয়ে তার নিজের গ্রামে চলে গেলো।

এর কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় মোতালেব চাচা তাঁর এক নতুন পরিকল্পনার কথা জানালেন। জানালেন তিনি একটা কলেজ করবেন। গতানুগতিক নয়। অর্থাৎ কলেজটিতে কাস হবে রাতে। পড়বে চাকুরীজীবী, বয়স্ক, মধ্যবয়সী শিক্ষার্থীরা। তাঁর এই নতুন পরিকল্পনায় তিনি আমাকেও জড়াতে চাইলেন। এভাবেই বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তিনি আমায় শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখালেন। আমি অবশ্য জানতাম ইতিপূর্বে জনাব আব্দুল মোতালেব মাত্র কয়েকদিনে ১৭০০ প্রাইমারি স্কুল তৈরী করে কয়েক হাজার বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন সেই ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে।

এছাড়াও তার সক্রিয় উদ্যোগ সহযোগিতায় কয়েক’শ মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা বেশ কয়েকটি কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্ত বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আমার ভিতরে এক তীব্র উত্তেজনা অনুভব করলাম। বিন্দু থেকে সিন্ধু সৃষ্টির কথা শুনেছি এবার শুন্য থেকে কিভাবে একটি কলেজ তৈরী হয় তাই দেখার অপেক্ষায় এই তীব্র উত্তেজনা। কারণ আমার ভিতরে এই প্রত্যয় দৃঢ় ছিলো যে জনাব আবদুল মোতালেব যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তখন কলেজ হবেই।

এ পরবর্তী ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী তো সাতক্ষীরায় অনেকেই। তার একক চেষ্টা, নির্দেশনা ও প্রযতেœ মাত্র দু’বছরের কলেজটি নৈশ থকে দিবা-নৈশ কলেজে রূপান্তরিত হলো। একই সাথে মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাদানের অনুমতি মিললো। প্রায় শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি বেতন ভাতার অন্তর্ভুক্ত হলো। সর্বোপরি কলেজটি পরিণত হলো সাতক্ষীরার অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নারী শিক্ষার প্রসারে ইতিপূর্বে তিনি কয়েকজনকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজ।

সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজটি প্রতিষ্ঠার পরপরই খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত কররেন কুমিরা মহিলা কলেজ। সেখানে আজ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাদানের কার্যক্রমও চলছে। এসব কর্মকান্ডের যিনি যোগী তাকে কি কৃতীপুরুষ অভিধায় অভিষিক্ত না করে কোনো উপায় থাকে। পূর্বেই বলেছি পিছিয়ে পড়া একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে, তাদেরকে দক্ষজনশক্তিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় জনাব আব্দুল মোতালেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটির পর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষানুরাগী এই কর্মপুরুষটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবাকে ছড়িয়ে দিতে রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটকে সম্ভব শক্তিশালী করেছিলেন। সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন কখনো নিজ পত্রিকায় নবীন লেখকদের লেখা ছাপিয়ে, কখনো সাহিত্য বৈঠকের আয়োজন করে। বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে তুলে ধরতে, সত্য ও ন্যায় প্রকাশের দুরন্ত সাহসে নিজে সাংবাদিকতা করেছেন, তৈরী করেছেন একগুচ্ছ সংবাদকর্মী সংবাদপত্রসেবী, কিশোর তরুণদের আত্মপ্রত্যয়ী নেতৃত্বদানে সক্ষম এক যুব সমাজে উত্তরণের জন্য দীর্ঘদিন যুক্ত থেকেছেন স্কাউট আন্দোলনের সাথে।

অথচ এসবের বিনিময়ে তাঁর পৈত্রিক বাড়ির কনক্রিটের ছাদে উঠেছে গোলপাতার ছাউনি, কখনো স্ত্রীর টাকায় মেটাতে হয়েছে প্রেস কর্মচারীদের বেতনভাতা, কাগজের দাম ইত্যাদি। আজ যখন কলেজের একটি শিক্ষকপোস্ট মেধাহীনদের কাছে ৮/১০ লক্ষ টাকায় বিক্রী হয়, নষ্ট মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে পতিত সাংবাদিক গড়ে তোলে অট্টালিকা, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদের আঁচল ধরে নষ্ট হয় কতিপয় শিক্ষক তখন বলতে ইচ্ছা হয় এই নষ্ট সমাজে, এই নষ্ট সময়ে আব্দুল মোতালেব আপনার জন্ম সত্যি এক দুর্ঘটনা। আর এইসব নষ্ট মানুষরাও আপনাকে কিছুমাত্র বুদ্ধিমান মনে করে না। তাতে কি? বিজ্ঞানীরা বলেন এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিও নাকি এমনি এক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। আপনি তাই চিরজীবী সকল সভ্য মানুষের হৃদয়ে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর