কীভাবে নুসরাতকে হত্যা? পুরো বিবরণ পিবিআই’র তদন্তে

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে আগামীকাল বুধবার (২৯ মে)। এজাহারে থাকা আটজনসহ বাইরের আরও আট জন, অর্থাৎ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আসামিরা কীভাবে নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে, তার পুরো বিবরণ উঠে এসেছে পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদনে।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৬ জনেরই মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হবে বলে মঙ্গলবার (২৮ মে) পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফির অভিযোগের ভিত্তিতে তার মা বাদী হয়ে সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানায় শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করেন। এর জেরে ৬ এপ্রিল সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে গেলে নুসরাতকে মিথ্যা কথা বলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আসামিরা পালিয়ে যায়। নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ছাদ থেকে নেমে আসার পর পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও নিরাপত্তাকর্মীরা তার শরীরের আগুন নেভান। এরপর আশঙ্কাজনক অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।

যেখান থেকে শুরু
নুসরাত জাহান রাফির অভিযোগ ও তার মায়ের দায়ের করা মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা গ্রেফতার হলে তার অনুগতরা ক্ষিপ্ত হয়। গত ১ এপ্রিল আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে। তখন সিরাজ উদ্দৌলা নিজের মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে তাদের নির্দেশ দেন। হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর পরও মামলা তুলে না নিলে আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া, আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম এ ঘটনার আগে নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে শাহাদাত হোসেন শামীম কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে। পরে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে তারা। কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা দেন। এই টাকা দিয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম পরিকল্পনা অনুযায়ী তার দূরসম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনায়। ৩ এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করে। তখন সিরাজ উদ্দৌলা তাদের নির্দেশ দেয় নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যা করার। একই সঙ্গে হত্যার পর ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেয় সে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ এপ্রিল বিকাল ৩টার দিকে মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুউদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহারসহ আরও কয়েকজন বৈঠকে বসে এবং নুসরাতকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ওইদিনই রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসার ছাত্রদের হোস্টেলে নুসরাতকে হত্যার বিষয়ে আবারও আলোচনা করে তারা। সে অনুযায়ী ৫ এপ্রিল বিকাল ৫টায় ভূইয়া বাজার থেকে আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম এক লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয় ৬ এপ্রিল। ওইদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদ্রাসা চত্বরে আসে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যায়। শাহাদাত হোসেন শামীম পলিথিনে করে আনা কেরোসিন ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়।

পিআইবির গ্রাফিক্সে নুসরাত হত্যাকামরুন্নাহার মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আরেকটি—মোট ৩টি বোরকা ও ৪ জোড়া হাতমোজা সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় নিয়ে রাখা হয়। শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় গিয়ে অবস্থান নেয়। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামি উম্মে সুলতানা পপি গিয়ে তাকে বলে, তার (নুসরাতের) বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে।

নুসরাত দৌড়ে পরীক্ষা কক্ষে গিয়ে তার ফাইল রেখে ছাদের দিকে যান। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে উম্মে সুলতানা পপি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে নুসরাতকে এবং ভয়ভীতি দেখায়। নুসরাত মামলা তুলবেন না বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে ওঠেন। আসামি কামরুন নাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ পেছনে পেছনে ছাদে যায়। এরপর তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় ও কয়েকটি কাগজে সই দিতে বলে। নুসরাত সই দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়।

পিবিআই’র তদন্তে জানা যায়, শাহাদাত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছন দিকে নিয়ে আসে। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেয়। জোবায়ের ওড়নাটি ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেলে। পপি ও মনি ওড়নার এক অংশ দিয়ে নুসরাতের হাত তার শরীরের পেছন দিকে নিয়ে বেঁধে ফেলে। আসামি জোবায়ের ওড়নার অন্য অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বাঁধে। আসামি জাবেদ পায়ে গিট দেয়। এরপর সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দেয়। শাহাদাত এ অবস্থায় নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে রাখে কামরুন নাহার মনি। আর নুসরাতের পা চেপে ধরে উম্মে সুলতানা পপি ও জোবায়ের। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকিয়ে রাখা কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন ঢেলে নেয়। এরপর নুসরাতের সারা শরীরে ঢেলে দেয়। এবার শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের দিয়াশলাই দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর জোবায়ের প্রথমে ছাদ থেকে নেমে যায়। এরপর নামে উম্মে সুলতানা পপি। তখন কামরুন নাহার মনি পরিকল্পনা অনুযায়ী পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডাক দিয়ে নিচে নেমে যায়। কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। আসামি জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে। জাবেদ তার বোরকাটি শাহাদাতকে দিয়ে দ্রুত নেমে গিয়ে পরীক্ষার হলে ঢোকে। শাহাদাত হোসেন শামীম ছাদ থেকে নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং মাদ্রাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেয়। আসামি জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টারের ছাদ থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং সে তার বোরকা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। আসামি নুরুউদ্দীন সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনাটি তদারকি করে। এছাড়া, আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারায় থাকে। মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারায় ছিল। নুসরাতের গায়ে আগুন লাগানোর পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।

আগুনে দগ্ধ হওয়ার কারণে নুসরাত নিচে নেমে আসার অবস্থায় ছিলেন না। তার হাত-পা বাঁধা ছিল। আগুনে বাঁধন পুড়ে যাওয়ার পর সিঁড়ি দিয়ে তিনি নিচে নেমে আসেন। তখন কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভান। ওই সময় আসামি নুরুউদ্দীনও ভালো সাজার জন্য নুসরাতের গায়ে পানি দেয়। আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরবর্তীতে নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। নুসরাত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন।

হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ নুসরাতনুসরাত নিহতের ঘটনায় গত ১০ এপ্রিল তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআিই। মামলার এজাহারনামীয় আসামি কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আলমকে ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়। পরদিন ১২ এপ্রিল এজাহারনামীয় দুই আসামি নুরুউদ্দীন ও জাবেদ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৩ এপ্রিল এজাহারনামীয় আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে এজাহারনামীয় বাকি আসামি হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী আরও ৭ জনকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়।গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এছাড়া ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৭ জনের সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতকে যৌন নিপীড়ের দায়ে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। এরপর ৬ এপ্রিল নুসরাতকে কৌশলে ওই মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা। পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় মারা যান নুসরাত।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর