বিদেশে পাচার: টার্গেটে রোহিঙ্গা নারীর

সংঘবদ্ধ একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। বিশেষ করে চাকরি দেওয়ার নাম করে রোহিঙ্গা নারীদের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ‘বিক্রি’ করার তথ্য পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে কৌশলে প্রথমে তাদের ঢাকায় এনে শেখানো হয় বাংলা। এরপর ভুয়া তথ্যে নেওয়া হয় পাসপোর্ট। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তাদের পাঠানো হয় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। এভাবেই গত এক বছরে চার শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে দেশের বাইরে। পাচার হয়েছে অনেক রোহিঙ্গা পুরুষও। এই চক্রের মূল হোতাসহ আটজনকে এরই মধ্যে শনাক্ত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে আব্দুস সবুর ওরফে রহিম নামের একজন মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছে এরই মধ্যে। সে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া পুরনো রোহিঙ্গা। তবে সবুর বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া রোহিঙ্গা নারী পাচারের সঙ্গে কক্সবাজার ক্যাম্পের দু’জন রোহিঙ্গা রয়েছে। সব মিলিয়ে চার দেশে বসে তাদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে এই চক্র। গত ১০ মে রাজধানীর খিলক্ষেতের একটি ফ্ল্যাট থেকে ২৪ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে ডিবি। বিদেশে পাচারের জন্য তাদের জড়ো করা হয় সেখানে। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের পাচার নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ ঘটনায় মো. মাজেদুল ইসলাম বাদী হয়ে মানব পাচার আইনে মামলা করেছেন একটি।

ক্যাম্প থেকে যেভাবে ঢাকায় আনা হয় :তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা নারীদের পাচারের জন্য কক্সবাজারের ক্যাম্পে পাচারকারী চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে কানা রফিক ও মফিজ নামের দুই রোহিঙ্গা। ক্যাম্প ঘুরে যেসব রোহিঙ্গা নারীকে খুব অসহায় মনে হয় তাদের, প্রথমে ঢাকায় নিয়ে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেয়। আবার কাউকে কাউকে বিদেশে নিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা জানায়। মিয়ানমারে যেসব রোহিঙ্গা নারী তাদের আত্মীয়স্বজন হারিয়ে এতিম হয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে, প্রথমে তাদের টার্গেট করে এই চক্রের সদস্যরা। রাজি করানোর পর রফিক ও মফিজ এসব রোহিঙ্গা নারীকে তুলে দেয় পাচারকারী চক্রের মো. আইয়ুব মোস্তাকিমের হাতে। এরপর বাস ও ট্রেনযোগে ঢাকায় এনে তাদের তিনটি ঠিকানায় তুলে দেয় সে। এই তিন ঠিকানা হলো- মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য ওয়ালিদ হোসেন কাজলের খিলক্ষেতের মধ্যপাড়ার বাসা, মো. ইব্রাহীম খলিলের গুলবাগের বাসা ও ফকিরাপুলের একটি হোটেল। গুলবাগের বাসায় অন্তত ২৫ রোহিঙ্গাকে বিদেশে পাচারের জন্য জড়ো করা হয়েছিল। ১০ মে খিলক্ষেতে অভিযানের ঘটনা টের পেয়ে গুলবাগের বাসা থেকে তাদের সরিয়ে নেয় পাচারকারী চক্র।

পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া :ডিবির তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় রোহিঙ্গাদের এনেই প্রথমে তাদের বাংলা শেখানোর কার্যক্রম করে মানব পাচারকারী চক্র। প্রত্যেক রোহিঙ্গা নারীর হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের একেকটি এলাকার ভুয়া ঠিকানাসংবলিত কাগজ। সেই ঠিকানা তাদের মুখস্থ করতে বলা হয়। সেটা সম্পন্ন হয়ে গেলে পাচারকারী এই চক্রের অন্যতম প্রধান আইয়ুব আকবার পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা নারীদের কোনো একটি এলাকায় নিয়ে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়। ভুয়া ঠিকানায় তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ সংগ্রহ করে দেয় এই চক্র।

নারীদের নামের পেছনে ‘আক্তার’ নামে অনেক পাসপোর্ট :একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর গুলবাগের বাসা থেকে মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা ইব্রাহীম খলিলের বাসা থেকে ৪৯টি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। ওই বাসাটি ইব্রাহীমের মেয়ের জামাই তোফাজ্জল হোসেনের। জেনেশুনেই শ্বশুরকে ওই বাসা মানব পাচারের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতে দেয় সে। ওই বাসায় জব্দ করা পাসপোর্টগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ৪/৬ পশ্চিম দেওভোগের ঠিকানার মিনারা বেগম। তার বাবার নাম দেওয়া আছে বদি আলম ও মা মাকসুদা বেগম। তার পাসপোর্ট নম্বর :ইএ-০৩৭৪০৩৮। কুমিল্লার সদর দক্ষিণের রাশিদা আক্তার। তার বাবার নাম আলী আজম ও মা ফরিদা বেগম বলে উল্লেখ করা হয়। তার পাসপোর্ট নম্বর :ইএ-০০৩৭১৪৯। গাজীপুর সদরের ডালিয়া নাসরিন নামের একজনের পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। তার বাবা আবুল হোসেন সরকার ও মা নাজমা বেগম। তার পাসপোর্ট নম্বর :ইএ-০১৯৬২৭৪।

আরও যাদের নামে পাসপোর্ট সেখানে পাওয়া যায় তারা হলো- মোহাম্মদ সাদেক, জাহিদ হোসেন, আনোয়ার সাদেক, মো. জাবের, মো. রোকনু, দেলোয়ার হোসেন, মো. আলম, এনামুল হক, মোহাম্মদ মোস্তাকিম, সোনিয়া, জসিম উদ্দিন, মো. ইউসুফ, মো. ইরফান, সাখাওয়াত হোসেন, জাফর আলম, হামিদুল হক, মো. সিদ্দিক, আরিফ হোসেন, আব্দুল মোতালেব, রাশিদা বেগম, সুফিয়া আক্তার, শিফা আক্তার, সালমা আক্তার, সাদেকা বেগম চৌধুরী, নূর হাসিনা, মনিরা আক্তার, নূর হাসিনা, মিসেস আয়েশা, মুক্তা আক্তার, সাজু, রফিকা আক্তার, সাজিদা আক্তার, রুমকি আক্তার, আয়শা আক্তার, সুমি আক্তার, সীমা বেগম, খুর্দিশা বেগম প্রমুখ।

মূল হোতা মালয়েশিয়া পালিয়েছে :তদন্তে উঠে এসেছে, রোহিঙ্গা নারী পাচারের এই চক্রের অন্যতম প্রধান হোতা আব্দুস সবুর। ১০ মে খিলক্ষেতে অভিযানের ঘটনা টের পেয়ে ওই দিন মালয়েশিয়া পালিয়েছে সে। সবুর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া পুরনো রোহিঙ্গা। সে ভুয়া তথ্য দিয়ে দুটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েছে। যেখানে তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে ‘আব্দুর সবুর’। তার পিতার নাম দেওয়া হয়েছে আবদুল জলিল। স্থায়ী ঠিকানায় দেওয়া আছে বালিয়াপাড়া, ৭ নম্বর ওয়ার্ড, কক্সবাজার। তার নামে একটি পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট।

মানব পাচারকারী এই চক্রের আরেক হোতা ওয়ালিদ হোসেন কাজল দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া পড়াশোনার পর সেখানে বৈধ-অবৈধভাবে কাজ করছিল। সেখানে থাকাকালে তার সঙ্গে পরিচয় হয় লোকমান নামের এক মানব পাচারকারীর। লোকমানের ঘনিষ্ঠ ছিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দিঘলীর মো. ইব্রাহীম খলিল। ইব্রাহীম ও লোকমানের ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ট্রলার রয়েছে। ওই ট্রলারের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট। মাস সাতেক আগে দুই রোহিঙ্গা মানব পাচারকারী দলের সদস্য আইয়ুব মোস্তাকিম ও আসমা আরেক মানব পাচারকারী কাজলের খিলক্ষেতের বাসায় ওঠে। তারা সেখানে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকত। আসমা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া পুরনো রোহিঙ্গা হওয়ায় কক্সবাজার থেকে আনা অন্য রোহিঙ্গাদের বাংলা শেখানোর কাজ করত। এই কাজে তাকে সহায়তা করত তোফাজ্জল হোসেন ভুঁইয়া নামের আরেক মানব পাচারকারী।

কার পকেটে কত যায় :ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আইয়ুব মোস্তাকিম, কাজল, তোফাজ্জল ও আসমা জানিয়েছে, চাকরির ফাঁদে পড়ে যেসব রোহিঙ্গাকে ঢাকায় আনা হয়, অনেক সময় তাদের পরিবারের সদস্যরা খুশি হয়ে জনপ্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। তবে একেকজনের পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বিদেশে পাঠানো পর্যন্ত খরচ পড়ে দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। জনপ্রতি বাকি অর্থ বিনিয়োগ করে আব্দুস সবুর। একেকজন রোহিঙ্গা নারীকে বিদেশে চার-পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। বাকি অর্থ চক্রের সদস্যরা ভাগ করে নেয়। সবুর তার মানব পাচারের চক্র সচল রাখতে বেতনভোগী কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়েছিল। অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারীকে প্রথমে ভারতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাঠানো হয়। আবার অনেককে সরাসরি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া নেওয়া হচ্ছিল।

পাচারের জন্য যাদের ঢাকায় আনা হয় :সর্বশেষ যে ২৪ জনকে পাচারের জন্য ঢাকায় আনা হয়েছিল তারা হলো- কক্সবাজারে সবুল্লা হাটা ক্যাম্পের আঞ্জুমা, বালুখালী ক্যাম্পের আয়েশা বেগম, জামতলী ক্যাম্পের আসমা, মুছনি ক্যাম্পের সুরাইয়া বেগম, কুতুপালং ক্যাম্পের নাজবী, জুলেখা বেগম, নূর কলিমা, শাবিকা, রফিকা, হামিদা বেগম, ছাইওমা, সোনোয়ারা, জাহিদা বেগম, নূর হাবা, সেতারা, সুফিয়া খাতুন, নুন নাহার, মিনারা, রেহানা আক্তার, নূর কলেমা প্রমুখ।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির পশ্চিম বিভাগের ডিসি মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় রোহিঙ্গা নারীদের এনে বিদেশে পাচার করে আসছিল একটি চক্র। তারা তাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছিল। জব্দ পাসপোর্টের ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে।’ ডিবির এডিসি হাবিবুন নবী আনিসুর রশিদ বলেন, ‘একটি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা ২৪ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পাঠানোর আগে তারা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।’ ডিবির সহকারী কমিশনার হান্নানুল ইসলাম বলেন, ‘ভুয়া তথ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কীভাবে তারা এত পাসপোর্ট পেল, তা তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এক হাজার রোহিঙ্গা পাচারের কথা স্বীকার করছে তারা। তার মধ্যে চারশ নারী।’

সূত্র: সমকাল

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর