জটা বাবার গল্প

ছোট চাচ্চু মন খারাপ করে বসে আছে ড্রইং রুমে। ভাদ্র মাসের প্রচন্ড গরম। বাসায় বিদ্যুৎ চলে গেছে। আইপিএস কাজ করছে না। জেনারেটর নষ্ট। ফ্ল্যাট মালিক এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মোল্লা মোকসুদ উদ্দিন বলেছেন ফ্ল্যাট ফান্ডে জেনারেটরের ডিজেল কেনার জন্য টাকা নেই। তাই জেনারেটরের ডিজেল কিনতে পারছে না।

ছোট চাচ্চু বলল,
প্রিয়তী, এই গরমে তোরা থাকিস কিভাবে?
চাচ্চু তুমি তো বরফের দেশে থাক। তাই তোমার কাছে মনে হচ্ছে ভীষণ গরম। আসলে তেমন নয় । আর আমাদের তো অভ্যাস হয়ে গেছে।
চাচ্চু তুমি যেখানে থাক সেখানে নাকি সুর্য দেখা যায় না। বরফে সব ঢেকে যায়।
তবে, অনেক সময় ঢাকা থাকে।

চাচ্চু তুমি এবার ক’দিন থাকবে।
আমি আর যাব না।
যাবে না মানে?
যাব না।
হা হা হা তোমাদের এখানে থাকব।
সত্যি চাচ্চু!
হ্যাঁ।
তুমি থাকলে তো অনেক মজা হবে। তুমি বলেছিলে, এবার রোবট পুতুল আনবে। চকোলেট আনবে। আমি আর পলটু ভাইয়া গতরাতে তোমাকে না জানিয়ে তোমার ব্যাগ চেক করেছি। দেখি কিছুই নাই। দুই প্যাকেট চকোলেট মাত্র।

না, মানে হ্যাঁ, আসলে আসার আগে কাজের চাপে সময় করতে পারি না। তবে সত্যি অনেক চকোলেট কিনে দেব।
আমি রোবট পুতুলের জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম। পাশের বাসার সানিলার রোবট পুতুল আছে।
ছোট চাচ্চু আমি কি চকোলেট নিতে পারি?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
কিন্তু একটা কথা, কারও জিনিস না বলে ধরতে হয় না।
চাচ্চু, আমি কিন্তু পলটু ভাইয়াকে বলেছিলাম।
আর তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বলে তোমাকে জাগাইনি।

কিন্তু চাচ্চু তুমি তো গতবার সুটকেস ভরে চকোলেট এনেছিলে।
কত ধরণের চকোলেট! সবচেয়ে বেশি মজা ছিলো Toblenoner। এবার …।
চাচ্চু তোমার কি মন খারাপ?
না মানে আমি রোবট প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলাম তার পোর্টেবল হার্ডড্রাইভটা পাচ্ছি না।
ওহ্্ চাচ্চু তুমি বলেছিলে রোবট নিকোলাস।

চাচ্চু বল না রোবট নিকোলাস এবার কি করবে।
দেখ দেশের বাইরে আমার কাছে বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু সে সমস্যা যে দেশে এসেও থাকবে তা বুঝতে পারছি না। যাক, তোমরা তো ছোট বুঝতে পারবে না।ছোট চাচ্চু খুব অন্যমনষ্ক হয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি চিন্তা করছেন বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনি জানিয়েছেন আগামীকাল সন্ধ্যায় একজন জটা বাবা আসবে। তখন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

চা হাতে ভাবি ড্রইংরুমে এসে বলল,
তোমার কি হয়েছে বল তো? সেই দুপুর থেকে দেখছি খুব মন মরা হয়ে বসে আছ। আগে তো তোমাকে কখনো এরকম দেখিনি।
ভাবি আসলে অনেকদিন হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।
বিষয়টি কিন্তু আমার কাছে অবাক মনে হচ্ছে। আমি শুনেছি বেশ কিছু ঘটনা, পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু তোমার বেলায়ও যে এরকমটা হবে কি-না তা বুঝতে পারছি না। আর তুমি যা বলছ তার সবই অদ্ভুত ব্যাপার।তোমার কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?
না ভাবি, সে রকম কিছু নয়।

তবে তোমার রোবট প্রজেক্টেও পোর্টেবল হার্ডড্রাইভটা বাসা থেকে কিভাবে হারিয়ে গেল বিষয়টি বুঝতে পারছি না। আগে কখনো এরকম হয়নি। তুমি কি আর একটু খুঁজে দেখবে?
খুঁজে দেখেছি ভাবি। আমি তো আমার এক বন্ধুকে বলেছি। সে সাহায্য করবে বলে বলেছে, কাল সন্ধ্যার পর লোকজন আসবে।

বাসার পরিস্থিতি থমথমে। ভাবি জটা বাবার বাসায় আসার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। তিনি বলছেন, পুলিশকে জানানো হয়েছে কিছুটা সময় লাগবে। দেখা যাক না কি হয়! কিন্তু ছোট চাচ্চুুর বন্ধু কিছুতেই মানছেন না। বলছেন, তিনি দেখিয়ে দিতে পারবেন। রোবট প্রজেক্টের পোর্টেবল হার্ডড্রাইভটা এখন কোথাও আছে। বেশি সময় নিলে অজানা জায়গায় চলে যেতে পারে সীমানার বাইরে। তখন যন্তরমন্তর কাঠিতে আর দেখা যাবে না। হার্ডড্রাইভ কোথায় আছে তাই জানার জন্য চাচ্চু রাজি হয়েছেন। ড্রইং রুম থেকে সেন্ট্রাল টেবিল সরানো হয়েছে। ড্রইং রুমের মেঝেতে বসে জটা বাবা যন্তরমন্তর বলবেন। তার দরকার হবে পরিস্কার গোসলের পানির পাত্র।

পানির পাত্রের ভেতর যে হার্ডড্রাইভ চুরি করেছে তার মুখ দেখা যেতে পারে। বিষয়টি পলটুর কাছে বেশ অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে বিষয়টি তার বন্ধুকে বলেছে। সে গম্ভীর মুখে বিকেল থেকে ড্রইং রুমে বসে আছে। জটা বাবার মাথায় নাকি লম্বা জটা চুল, গায়ে গেরুয়া বসন, হাতে যন্তরমন্তর কাঠি।

পলটু ছোট চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেছিল, রোবট প্রজেক্টের হার্ডড্রাইভে কি ছিল?
চাচ্চু বলেছেন, নতুন রোবট প্রজেক্টের হার্ডড্রাইভে রোবট নিকোলাসের নতুন সংস্করণ তৈরির যাবতীয় সফটওয়্যার এবং পরিকল্পনা ছিল।
এই প্রজেক্টের রোবট নিকোলাস কি করবে চাচ্চু।
এবার রোবট নিকোলাস মস্ত বড় কাজ করবে, কি কাজ?
বিরাট কাজ, এখন বলা যাবে না। বিষয়টি ট্রেড সিক্রেট, যে কারনে নতুন আবিস্কারের প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত গোপন রাখতে হবে।

মা বলেছিল,
তোর চাচ্চু রোবট নিয়ে কাজ কওে, আবার মন্ত্রতন্ত্রেও বিশ্বাস করে। এ যুগের মানুষদের এসবে বিশ্বাস করতে নেই। চাচ্চু বলেছেন, অনেক সময় বিশ্বাসে কাজ হয়। দেখা যাক না, বিজ্ঞান আর যন্ত্ররমন্তর মিলে কোন ফল পাওয়া যায় কি না?

সন্ধ্যার পর জটা বাবা এলেন। তার মাথায় লম্বা লম্বা জটা চুল। বাড়ি পঞ্চগড় শহরে। সে শহরে তিনি জটা বাবা নামে পরিচিত। জটা বাবার সাথে এসেছেন তার দুই সাগরেদ। তাদেরও লম্বা লম্বা জটা চুল। জটা বাবার শরীরে গেরুয়া রঙের জামা, সাথে কাপড়ের ব্যাগ । জটা বাবার মুখ গম্ভীর।
তিনি ঘরে ঢুকেই বললেন, বালতি এনেছিস? পরিস্কার পানি।
হ্যাঁ আপনার সামনেই তো।

নাহ! এই পানি পরিস্কার না। আরও পরিস্কার পানি দরকার। যাতে মানুষের মন পরিস্কার হয়।
মানুষকে মানুষ রুপে দেখা যায়। এখন তো মানুষ আর মানুষ নাই।
চাচ্চু মহাবিপদে পড়লেন।
পলটু চাচ্চুর কাছে এসে বলল, চাচ্চু এ্যাপার্টমেন্টের টেপের পানি কিছুটা ঘোলা হয়। পাশের গ্রোসারি থেকে ফিল্টার পানি নিয়ে আসি।
ঠিক আছে নিয়ে আয়।

জটা বাবা বললেন, বল তোর নাম কি? তোর কাউকে সন্দেহ হয়?
না। আমি বিদেশ থেকে এসেছি, আমি কিভাবে জানবো?
বালতিতে পরিস্কার পানির ব্যবস্থা হয়েছে।
বালতির তলায় জটা বাবা এক প্রকার রুপালি রঙয়ের কাগজ বিছিয়ে দিয়েছেন।
জটা বাবা আর তার দুই সাগরেদ বালতির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। পলটুর মনে হলো এটা ভুতের বাড়ির দৃশ্য। কি সব আলৌকিক কা-।

তার বাই ফোকাল লেন্সের চশমার অর্ধেক খুলে যাচ্ছে। সত্যিই কি পানির ভেতর মানুষের মুখ দেখা যাবে?
জটা বাবা বলতে লাগলেন,
‘হিং টিং শট, ভুতের বাড়ির যত ঘট, খুলে যা যত জট …’।
তার হাতে একটা লাঠি। চন্দন কাঠের কারুকাজ করা লাঠি দিয়ে পানিতে লাগিয়ে বালতির দিকে লাঠি তাক করলেন। তার সাগরেদরা বালতির চারদিকে ধীর গতিতে ঘুরতে লাগল।

প্রিয়তীর মনে হলো পানিতে কিছুটা কম্পন হচ্ছে। জটা বাবা আবারও বালতির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগলেন এই পানিতে গোসল করলে মন পরিস্কার হয়ে যাবে। পবিত্র পানি। হিং টিং শট …।
জটা বাবা আবারও বালতির পানির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন …।
পলটু অবাক হয়ে এসব দেখছিল। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।

প্রিয়তীর মনে হলো পুরুষ মানুষের চুল এতো লম্বা হয়? তাও আবার মেয়েদের মতো বেনি করা। তার কাছে বিষয়টি খুবই অবাক লাগছে। সে কখনও এরকম জটা বাবা দেখেনি। আচ্ছা জটা বাবার লাঠিতে কি জাদু আছে? যা দিয়ে বালতি ভর্তি বিদেশি চকোলেট আনতে পারবে? প্রিয়তী দেখতে লাগলো বালতি ভর্তি সব বিদেশি চকোলেট।

জটা বাবা আবার বলতে থাকলেন,
‘দেশের বদ্যি দেশে থাক, নাও ভেড়াতে বিদেশ যাও।
সরষেতে ভুত, ভুত তাড়াতে লাগাবে যত ঘুট…’।
আস্তে আস্তে বালতির পানিতে মৃদু কম্পন শুরু হচ্ছে। সবাই উদগ্রীব হয়ে পানির বালতির দিকে তাকিয়ে আছে। যদি চোরের মুখ দেখা যায়!

ছোট চাচ্চুর মনে হল সত্যিই কি পানির মধ্যে মানুষের মুখ দেখা যেতে পারে? বিজ্ঞান কি বলে? তিনি বিজ্ঞানের সাথে কল্পনা মিশিয়ে চিন্তা করলেন। তিনি ছোটবেলায় অনেক অলৌকিক বিষয় সম্পর্কে শুনেছেন, জাদু দেখেছেন। জাদু হচ্ছে এক প্রকার চোখের ধাধা। হয়তো বা বিজ্ঞান আর কল্পনা মিশিয়ে নতুন কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে।

সত্যিই যদি পোর্টেবল হার্ডড্রাইভটা পাওয়া যেত! তিনি অবাক হয়ে বালতির পানির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হয়তো বা ছোট চাচ্চুর হার্ডড্রাইভটা বালতির পানির মধ্যে দেখা যাচ্ছে সেটি এখন কোথায় আছে?
জটা বাবা আবারও বললেন,
‘জলের নাও, জলের মাঝি
জলের মধ্যে মানুষ খুঁজি …’।
জটা বাবা বালতির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। সাগরেদ দুইজন তার সাথে সাথে ঘুরছে। তার ঘূর্ণয়মান ছন্দের সাথে সাথে বালতির পানিতে এক প্রকার আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে।

শীতের শুরুতে বার্ষিক পরীক্ষার পর পলটুর প্রিয়তীর স্কুল বন্ধ। ছোট চাচ্চু চলে গেছেন। তার রোবট প্রজেক্টের হার্ডড্রাইভ আর পাওয়া যায়নি। যাবার সময় তার মন ভীষণ খারাপ ছিল।ভাবি জানালায় পাশে এসে দাড়িয়েছেন, মনে হল এ্যাপার্টমেন্টের পানি খুব অপরিস্কার। গোসলের জন্য খুব স্বচ্ছ পানি দরকার।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর