ইউএনওদের জন্য কোটি টাকার গাড়ি!

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কিনছে সরকার। সুপরিসর, শক্তিধর ও পর্যাপ্ত গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্সের ফোর হুইল ড্রাইভের যে গাড়ি ব্যবহার করেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও সমমানের কর্মকর্তারা, সেই গাড়ি কেনা হচ্ছে মাঠ প্রশাসনের জুনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য। এত দামি গাড়ি কেনা নিয়ে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ইউএনওদের জন্য ৫৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দামের গাড়ি কেনার। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৯১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা দামের পাজেরো স্পোর্টস কিউ এক্স মডেলের জিপ কেনার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে তা অনুমোদনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠিয়েছে। কমিটির আজকের সভায় তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। আপাতত ১০০টি গাড়ি কেনা হবে কোনোরকম দরপত্র আহ্বান না করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে। দীর্ঘ সময় লাগার অজুহাতে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে কেনার পথে না হাঁটার পক্ষে জনপ্রশাসন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ইউএনওদের জন্য পাজেরো স্পোর্টস কিউ এক্স মডেলের জিপ কেনার বিষয়টি অর্র্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে অনুমোদন পেলে ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। গাড়িগুলো কেনা হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউএনওদের জন্য সর্বশেষ ২০০৬ ও ’০৭ সালে ২৫৫টি গাড়ি কেনা হয়েছিল। সে সময় প্রতিটি গাড়ি কিনতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৮ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। চলতি বছর ১০০ গাড়ি কেনার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। প্রতিটি গাড়ি কেনার জন্য ৫৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা হারে বরাদ্দও রাখা হয়েছিল। সে অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১০ জানুয়ারি ইউএনওদের গাড়ি কেনার প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হয়। গাড়িগুলো কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ সম্মতির চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছার পর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা আপত্তি জানাতে থাকেন। তারা আরও দামি গাড়ি কেনার পক্ষে অবস্থান নেন। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে

চিঠি চালাচালি শুরু হয়। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয় অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ১০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, প্রতিটি ২৭০০ সিসির গাড়ি কেনার জন্য ৯১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা হারে মোট ৯১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ের সম্মতি দেওয়া হয়।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আগে ইউএনওদের যে মানের গাড়ি দেওয়া হয়েছিল, এখনো সেই মানের গাড়ি দেওয়া উচিত। অযথা খরচ বাড়ানো উচিত নয়। তাছাড়া গাড়ি কেনার পর তার রক্ষণাবেক্ষণে অনেক অনিয়ম হয়। এসব গাড়ি যেন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার।

ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম এবং পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন। এসব কাজ পরিচালনার জন্য ইউএনওদের প্রয়োজনীয় জনবলসহ প্রতিনিয়ত সরকারি যানবাহন ব্যবহার করতে হয়। ২০০৭ সালে ইউএনওরা যে গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন তা মেয়াদোত্তীর্ণ। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে জনস্বার্থে মেয়াদোত্তীর্ণ পুরাতন জিপ গাড়িগুলো প্রতিস্থাপন করা জরুরি। প্রতিস্থাপন ছাড়া গাড়িগুলো অকেজো ঘোষণা করা হলে প্রশাসনিক কর্মকা-ে স্থবিরতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে সারসংক্ষেপে।

সরকারি পরিবহন পুলের পরিচালক মো. শাজাহান আলী জানান, ইউএনও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্র্বাচনে কাজ করেন। তাকে নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে হয়, ইউনিয়ন পরিষদ, সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাটবাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে যেতে হয়। এসব যাতায়াতের রাস্তা সব জায়গায় পাকা বা সমতল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রামীণ কাঁচা রাস্তায় চলাচল করতে হয়। অনেক রাস্তায় স্পিড ব্রেকার রয়েছে। এসব অন্তরায় অতিক্রমের জন্য গাড়ির পর্যাপ্ত গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স থাকা প্রয়োজন। এছাড়া কাদামাটির গ্রাম্য রাস্তায় চলাচলের জন্য অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ফোর হুইল ড্রাইভের যানবাহন দরকার। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ভালো মানের জিপ গাড়ি কেনার সুপারিশ করেছে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর।

দশম সংসদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকেও ইউএনওদের জন্য জিপ গাড়ি কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানান, উন্মুক্ত দর পদ্ধতিতে ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়ায় চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে ১০০টি গাড়ি কেনা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় উন্মুক্ত দর পদ্ধতির বদলে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে গাড়ি কেনার সুযোগ অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গাড়িগুলোর দাম ৫০ কোটি টাকার বেশি হওয়ায় বিষয়টি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণের বিষয়টি অনুমোদন করবে।

জানা গেছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ইউএনওদের গাড়ি কেনার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে সংশোধীত বাজেটে তা কমিয়ে ৬০ কোটিতে নামানো হয়। এই অবস্থায় মে ও জুন মাসের মধ্যে বাজেট সংশোধন করা সম্ভব নয়। তাই ৬০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে গেলে আর্থিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।

বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউএনওদের জন্য এত বিলাসবহুল গাড়ি কেনার নেপথ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। সাধারণত পুলিশের কর্মকর্তারা বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। তাদের কাজের ধরনের জন্যই বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্যও বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হচ্ছে। গত বছর সহকারী কমিশনারদের (এসিল্যান্ড) গাড়ি কেনা হয়েছে প্রতিটি ৫২ লাখ টাকা দরে। ইউএনওদের তুলনায় এসিল্যান্ডরা অনেক বেশি প্রান্তিক এলাকায় যাতায়াত করেন। তারা ৫২ লাখ টাকার গাড়িতে চলাচল করতে পারলে ইউএনওরা কেন পারবেন না।

সূত্র: দেশ রুপান্তর ।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর