যে ঘটনার পর এলো মহান মে দিবস

প্রতি বছর মে মাস আসে আবার যায়। মে মাসের প্রথম দিনটি ১ মে বিশ্বের শ্রমিকদের কাছে চিরস্মরণীয় অম্লান একটি দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। সেই থেকে ১ মে রক্ত ঝরা দিন হিসেবে বিশ্বের শ্রমিকরা সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

মে দিবস এক দিনে ঘটেনি। এর একটি দীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রামের প্রেক্ষাপট রয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মালিকরা শ্রমিকদের ওপরে অমানবিক নির্যাতন করত। তাদের ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শ্রমিক কখনও কখনও কলের পাশে ঘুমিয়ে পড়ত। তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হতো। বছরের পর বছর ধরে এই নির্যাতনের প্রতিবাদে শ্রমিকরা মাঝে মাঝে প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন, আন্দোলন করতেন। কিন্তু মালিকদের লেলিয়ে দেয়া গু-াবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হতো। মালিকরা শ্রমিকদের দিয়ে ১৬-১৮ ঘণ্টা অমানবিকভাবে কাজ করতে বাধ্য করতেন। বিপরীতে মজুরি দিতেন কম। শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতেন। মালিকদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, শ্রমিকদের তারা তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেন। ১৮৮২ সালে কানাডায় এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন। কিন্তু কারখানার মালিকরা এ দাবি মেনে নেননি। এ দাবিতে ১ মে ১৮৮৬ সালে শ্রমিকদের সমাবেশের ওপর মালিকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ অতর্কিত হামলা করে, যা রূপ নেয় সংঘাতে। এ সংঘাতে ১১ শ্রমিক শহীদ হন। ৮ শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৭ সালে ১১ নবেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন শ্রমিক একদিন পূর্বেই কারা অভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পিজ নামে একজন শ্রমিক নেতা বলেছিলেন ‘আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা একদিন তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।’

১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনদের গবর্নর অভিযুক্ত ৮ জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং সংঘাতের হুকুম প্রদানকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবি অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। এ স্বীকৃতির পেছনে শত সহস্র শ্রমিকের রক্ত আর কত নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী জড়িত রয়েছে, যা কালের অমোঘ নিয়মে মহাকালের বুকে হারিয়ে গেছে। এসব ইতিহাস জানা এবং এর তাৎপর্য উপলব্ধি করে আজও সারা বিশ্বের শ্রমিকরা দাবি আদায়ের পথ হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে উজ্জীবিত হচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আদায়ে সোচ্চার। সব দেশেই তারা মানবাধিকার প্রশ্নে মোড়লিপনা করে। সেই যুক্তরাষ্ট্র আজও শ্রমিকদের সংহতি দিবস ১ মে’কে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের শ্রমিকরা মে দিবস পালন করতে পারে না। সে দেশে শ্রমিকরা আজও মৌলিক অধিকার ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর তারা কি দেবে? শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ব্যতীত বিশ্বের সব দেশে মে দিবস পালিত হয়ে থাকে।

শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে স্মরণ করে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মে বিশ্বব্যাপী মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে’কে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়াসহ পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে এবং সকল দেশে শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহ্বান জানায়। এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রাধান্যের কারণে অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশে বেশ গুরুত্ব সহকারে মে দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয় মে দিবস।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর