ঘিওরে ফসলী জমির মাটি ব্যবসা রমরমা কমে যাচ্ছে কৃষি জমি,ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে

মানিকগঞ্জ ঘিওরে ফসলী-আবাদী জমি ও নদী থেকে মাটি বিক্রির ধুম পরেছে। ক্ষমতাসীন এক শ্রেণীর ভূমিখেকোরা আইনের তোয়াক্কা না করেই অবাধে চালাচ্ছে এ মাটির ব্যবসা। অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিকদের যারা মাটি বিক্রিতে অস্বীকার করছেন, তাদের হুমকী ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে। বাদ পরছে না নদী তীরবর্তী পাড় বালুমাটি। গ্রামের পর গ্রাম এই মাটি বেচে দেওয়ার সর্বনাশা কান্ডে মেতেছে সংঘবদ্ধ ওই চক্রটি।

এতে যেমন ফসল ফলানোর জায়গা ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়ছে ব্রীজ, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী থাকায় কোনো কৃষক লিখিত অভিযোগ করতে সাহস পাচ্ছেনা। মৌখিকভাবে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাটি ব্যবসায়ীরা লোকজনকে কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে গ্রামের ফসলি জমি বিভিন্ন স্থানে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে নিচ্ছে ইটভাটায় ও বাড়িতে বাড়িতে। উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নে ভালকুটিয়া, আঙ্গারপাড়া, পুরানগ্রাম, পুখরিয়া-বাষ্টিয়ার মাঝে ফসলি জমি ও পুকুরে মাটি। ধূলন্ডি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায়। বড়টিয়া ইউনিয়নের তিন ফসলী জমির মাটি কাটছে মৌহালী, করজোনা, শ্রীবাড়ি, বড়টিয়া বাজার এলাকায়।

সিংজুরি ইউনিয়নের চরবাইলজুরি। ঘিওর সদরে নদীর পাড়ে। বানিয়াজুরি ইউনিয়নে শোলধারা, নয়াচর, তরা এলাকায় ভেকুদিয়ে মাটি কাটছে কিছু ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা।
ঘিওরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় অনেক ইট ভাটা, পুকুর, ডুবা, নালা থাকার কারণে মাটির চাহিদা বেশি। মাটি ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটি নিয়ে লোকজনকে কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে নির্বিচারে মাটি কেটে ইটভাটায় বেচে দিচ্ছে। ফলে অধিক মুনাফার লোভে নির্বিচারে চলছে মাটি কাটা। এভাবে মাটি কেটে নেওয়ার কারণে যেমন ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে এলাকার ঘর-বাড়ি। তেমনি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। এছাড়া মাটিবোঝাই ভারি ড্রাম ট্রাক চলার কারণে নষ্ট হচ্ছে রাস্তা-ঘাট। ধুলোবালিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

মাটির উপরের টপ সয়েল অংশ কেটে নেওয়ার ফলে জমির শ্রেণী পরিবর্তন হচ্ছে। কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে নালা অথবা জলকড়া জমিতে পরিণত হচ্ছে। সরজমিন পরিদর্শনে গেলে একাধিক গ্রামবাসী জনান, যে পরিমান বালিয়াখোড়া ও নালী ইউনিয়নে ভেকু দিয়ে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করছে তা আগামী পাচঁ বছরের মধ্যে কোনো ফসলি জমি থাকবেনা।

এদিকে উপজেলার নালী এলাকায় এক প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ীর মাটি কাটার ফলে ফসলী জমি নষ্ট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফসলী জমির মাটি পরিবহনের ট্রাক চলাচলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী জমিগুলো। এমনকি এক জমিতে ভেকু দিয়ে গভীর খননের ফলে পাশের জমিও ভাঙনের কবলে পরে। তাই ওইসব কৃষকরা কমদামেই জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী। এ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডে হেলাচিয়ার চকে ও বাঠুইমুড়ি-কলতা সড়কের ব্রীজের ডান পাশের চকের কৃষি জমি থেকেও মাটি কাটা হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন ওই নেতা নালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার তিনফসলি কৃষি জমির মাটি খননযন্ত্র (ভেকু) দিয়ে মাটি কেটে ইটের ভাটাসহ স্থানীয় বসতবাড়ি ভরাট মাটি বিক্রি করে আসছে। অন্যের ফসলি জমির ওপর দিয়ে ট্রাক চলাচলের জন্য বানানো হয়েছে রাস্তা।

মাটিবহনকৃত এসব ট্রাক চলাচলের ফলে ওইসব ফসলি জমিতে আর ফসল ফলানো যাবে না বলে জানান স্থানীয় কয়েকজন কৃষক। তবে, মাটির ব্যবসায়ী সরকার দলীয় হওয়ায় এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে এই কাজ করছে। ফলে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায়না বলে জানান এলাকাবাসী।

হেলাচিয়া গ্রামের স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, গত বছর আমার পাশের জমি থেকে মাটি কাটে আসাদ খান। ট্রাক চলাচলের জন্য আমার জমির ওপর দিয়ে রাস্তা বানায়। ট্রাক চলাচলের জন্য আমার জমি ব্যবহার না করতে বলায় আমাকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায় এবং জোড় করেই জমি ওপর দিয়ে রাস্তা বানায়। পরে কিছু টাকা দেবে বলেছিল কিন্তু মাটি কাটা শেষে ওই টাকাও আমকে আর দেয়নি। আমরা তো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাই কিছু বলতেও পারি না কারণ তারা আওয়ামীলীগ করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের এক নেতা বলেন, প্রতিবছরই এলাকায় কৃষি জমির মাটি কিনে বিক্রি করছে এক নেতা। জমির মালিকের কাছ থেকে মাটি কিনে কাটা শুরু করে। তারপরে পাশের জমির মালিকের মাটিও বিক্রি করতে বলে। কেউ সেচ্ছায় দিতে না চাইলে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোড় করে কম দামে জমির মাটি কিনে নেয়। এতে কৃষি জমির পরিমান যেমন কমে যাচ্ছে আবার যে জমির মাটি কাটা হয় তার পাশের জমির ভারি বৃষ্টি হলেই পার ভেঙে পরে ফসলের ক্ষতি হয়।

আবাদী জমির মাটি কেটে এলাকার বসতবাড়ি ভরাট, বাজারের মার্কেটের জায়গা ভরাটসহ ইটের ভাটায় মাটি বিক্রি করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নালী ইউপি আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ খান বলেন, আমি এক ফসলি জমি কিনে মাটি কাটছি। তিন ফসলি জমি কেউ বিক্রি করতে চাইলে আমি কিনি না। আমি জোড় করে কারও জমিতে মাটি কাটিনা। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই কিভাবে ম্যানেজ করে মাটি কাটতে হয় তা আপনারা জানেন। আমি এপর্যন্ত অনেক সাংবাদিককে ম্যানেজ করেছি আপনারা ঊনষাট নাম্বার।

এ ব্যাপারে ঘিওর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী সরকার রাখী জানান, বেশি গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। জমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে অনুমোদন লাগে। এছাড়া ওই ছোট সড়ক দিয়ে ড্রাম ট্রাক চলতে নিষেধও রয়েছে। ইতিপূর্বে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা এবং ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

অভিযোগ পাওয়া মাত্রই এসব বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। কৃষি জমি থেকে যারাই মাটি কাটার সাথে জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে অব্যশই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর