পথশিশুদের বিশ্বকাপ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

‘পথশিশু’ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে কিছু সাধারণ দৃশ্য ভেসে ওঠে। সেটা হতে পারে, এক ঝাঁক শিশু রাস্তায় ঘুরেঘুরে বোতল, কাগজ সংগ্রহ করছে। কিংবা রেলস্টেশন, বাসস্টপ বা লঞ্চঘাটে শুয়ে রাত পার করছে। অথবা, খোলা ডাস্টবিনের পাশে বসে সেখান থেকে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। হতে পারে পলিথিনে নাক ডুবিয়ে মাদক গ্রহণ করা জরাজীর্ণ কোনো শিশুর মুখচ্ছবি।

কিন্তু এই দৃশ্যগুলোর বাইরেও যে তাদের যাওয়া সম্ভব, কিছু করা সম্ভব -সে কথা আমরা ভাবি না, নচেৎ ভাবতেই জানি না, কেউ ভাবলেও সেই ভাবনা অন্যদের বিশ্বাসে কতটুকু জায়গা করে নিতে পারবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্তত এটা আমরা কখনওই ভাবি না যে একজন পথশিশু ‘ক্রিকেটের মক্কা’ লর্ডসের মাটিতে বল হাতে দৌড়াতে পারে! পারে বিপরীত থেকে আসা প্রতিপক্ষের কোনো বলকে পরিণত করতে ছয় কিংবা চারে। কিংবা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেম্বারদের সাথে বসে করবে ডিনার!

আমাদের কাছে বিষয়গুলো একেবারেই স্বপ্ন, অভাবনীয়। অথচ এই স্বপ্নগুলোকে সত্যি করার উদ্যমী সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে ‘স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বের নয়টি দেশ নিয়ে আগামী ৩০ এপ্রিল থেকে ৯ মে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে স্ট্রিট ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ-২০১৯ এর প্রথম আসর। বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মরিশাস, তানজানিয়া, কঙ্গো, নেপাল এবং ভারত থেকে ভারত (উত্তর) ও ভারত (দক্ষিণ) নামে মোট দশটি দল থেকে চারজন ছেলে ও চারজন মেয়ে নিয়ে মোট চল্লিশ জন ছেলে চল্লিশ জন মেয়ে অংশ নেবে এই প্রতিযোগিতায়, যাদের সবার বয়স আঠারো বছরের নীচে।
‘স্ট্রিট-২০’ নামক ক্রিকেটের নতুন এক ফরম্যাটে খেলবে প্রতিযোগিরা। যেখানে প্রতি দল থেকে তিনজন ছেলে ও তিনজন মেয়ে মূলখেলায় অংশ নেবে। মোট বল করা হবে ২০ টি।

বাংলাদেশ থেকেও আট কিশোর-কিশোরী স্বপ্ন দেখছে এই রথের সারথি হতে। বারো থেকে ষোল বছর বয়সী এই শিশুদের স্বপ্ন দেখিয়েছে ফরহাদ হোসেন প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবাভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘লিডো’। লিডো পথশিশুদের জন্য গড়ে তুলেছে পিস হোম। এই পিস হোমে থাকা চুয়ান্ন জন শিশুর মাঝেই বেড়ে উঠেছে স্বপ্না, নিজাম, আরজু, রুবেল, সানিয়া, রাসেল, জেসমিন ও কাশেম। একটু একটু করে বড় করে তুলছে তাদের স্বপ্ন গুলোকে। তারা এখন স্বপ্ন দেখছে লর্ডসের মাটিতে পা রাখার। স্বপ্ন বলছি, কারণ পথশিশু পরিচয়ে বিদেশে যাওয়া যায় না। স্বপ্নের মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় পাসপোর্ট জটিলতা। তবে, লিডোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং আদালতের সহযোগিতায় জ্বলেছে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সবুজ বাতি।

একসময় পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এসব শিশুরা এখন লেখাপড়া করছে। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারছে। কথার মাঝে দুই একটা ইংরেজি শব্দ বলছে। এই আয়োজনের অংশ হিসেবে তারা কংগ্রেস, আর্ট ফেস্টিভাল, প্রেস মিট, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেম্বারদের আমন্ত্রণে বিশেষ ডিনার ও প্রীতি ম্যাচে অংশ নেবে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। দেশত্যাগের আগে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে দোয়া নিতে চেয়েছে। হতে পারে এই অংশগ্রহণই তাদের ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দেবে। সেই পথ ধরে তারা এগিয়ে যাবে দূর থেকে বহুদূরে।

ইতোমধ্যেই অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কিংবদন্তী ক্রিকেটারদের নিয়োগ করা হয়েছে। ভারত থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি, শ্রীলঙ্কা থেকে কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা ইংল্যান্ডের মন্টি প্যানেসার মতো বাংলাদেশের পক্ষে সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন শিশুদের সাথে যাচ্ছেন। শিশুদের জন্য মোহাম্মাদপুরের সোনালী সংঘ ক্লাব মাঠে অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছে বিসিবি।

এগুলো এখনও স্বপ্ন। হয়তো সত্যি হতে চলেছে। পথশিশুদের চিত্রটা এভাবে বদলে যাক। আট জনের বদলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যে বিপ্লবের শুরু হলো, সে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ুক সারা পৃথিবীতে। বিপ্লব চলুক আর একটিও পথশিশু রাস্তায় থাকা পর্যন্ত। পথশিশু শব্দটাই নিক্ষেপিত হোক কোনো খোলা ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায়।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর