পানি দাও,ময়লা না

জুরাইনের মিজানুর রহমান, পূর্ব রামপুরার মনিরুল ইসলামসহ রাজধানীর কয়েকজন বাসিন্দা বেলা ১১টার দিকে উপস্থিত হন কারওয়ান বাজারের ঢাকা ওয়াসা ভবনে। তাদের হাতে ছিল কাচের জগ, জগে ওয়াসার পানি, গ্লাস, কয়েকটি লেবু, চিনির প্যাকেটসহ সরবত তৈরির উপকরণ।

কেন এসেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি রাজধানীবাসী পানির সমস্যায় রয়েছে। ওয়াসার পানিতে যে পরিমাণ আইরন থাকে, যে পরিমাণ দুর্গন্ধ থাকে, তা সবার জানা। কিন্তু ওয়াসার এমডি এই পানি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না। পুরো রাজধানীবাসী তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। নিন্দা জানাচ্ছে। আমরাও বলতে চাই, আমরা যেহেতু রাজধানীতে বসবাস করি, আপনিও রাজধানীতে বসবাস করেন, আপনারাও বসবাস করেন, সবাই জানেন ওয়াসার পানিতে ময়লা আছে। দুর্গন্ধ আছে।’

কোন এলাকা থেকে এসেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এসেছি পূর্ব রামপুরা থেকে। আমাদের এই কর্মসূচিতে যারা আছেন, তারা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকেই এসেছেন।’ এ সময় তিনি উল্টো প্রশ্নে করেন. ‘আপনি শতভাগ পিওর পানি পান কি না? আমার মনে হয়, আপনিও সেম (একই বক্তব্য) বলবেন, পিওর পানি নাই। তাহলে তিনি (ওয়াসার এমডি) কেন এ রকম বক্তব্য দিলেন? কেন এমন কথা বললেন সেটা আমাদের বুঝে আসে না। তাকে সরবত পানের অফার করব। তাকে সম্মান করেই আমরা সরবত খাওয়াব, যাতে উনি বুঝতে পারেন।’

‘রাজধানীতে যদি শতভাগ পিওর পানি হয়, তাহলে পানি পরীক্ষা করতে এত মেশিন কেন? বিভিন্ন ধরনের পানির কোম্পানি তৈরি হয়েছে কেন?’তিনি বলেন, ‘ওয়াসার পানি যদি দূষণমুক্ত হয়, তাহলে এত মেশিনের দরকার নাই। এত পানির কোম্পানির দরকার নাই। রাজধানীর প্রত্যেকটা ভবনে দেখতে পাবেন বিশুদ্ধ পানির জন্য মেশিন রয়েছে। কেন এই মেশিনগুলো রাখা হয়েছে?’

‘ওয়াসার পানি যদি শতভাগ পিওর হয়, তাহলে এত মেশিন কেন? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। এমডি নগরবাসীর কথা না শুনে কীভাবে বক্তব্য দিয়ে বলেন ওয়াসার পানি পরিশুদ্ধ?’মনিরুলের পাশেই অবস্থানকারী আরেরকজন বলেন, ‘ওয়াসার এমডির সঙ্গে দেখা করব কিন্তু পুলিশ যেতে দিচ্ছে না। ওয়াসার এমডি আমাদের দেওয়া বেতনে চলেন। অথচ আমাদের সেবা দেন না।’

অবস্থানকারীদের প্রথমে ওয়াসা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। পরে তারা ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন।মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জুরাইন রেলগেট ও পূর্ব রামপুরা থেকে পাঁচ জন কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের সামনে আসেন। রাজধানীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়াসার পানি কতটা ‘সুপেয়’ তা দেখানো ও সেই পানি দিয়ে সরবত তৈরি করে এমডিকে পান করানোর জন্য তারা কর্মসূচির অংশ হিসেবে এখানে আসেন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত এমডি বা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কারো সঙ্গে তারা দেখা করতে পারেননি।

গতকাল সোমবার জুরাইনের এসব নাগরিকের পক্ষ থেকে ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে সরবত পান করানোর কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার এসব ব্যক্তি ওয়াসা ভবনের সামনে আসেন।

জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান ওয়াসার এমডির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দায়িত্বশীল পদে থেকে একজন এ রকম কথা কীভাবে বলেন!’

তিনি আরও বলেন, ওয়াসার এমডিকে তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে। এ ছাড়া পানির জন্য এত দিন যে বিল দিয়ে এসেছেন, তা ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানি না দেওয়া পর্যন্ত তারা পানির বিল দেবেন না।

মিজানুর রহমান তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আসেন। তার হাতে থাকা কাচের জগে ঘোলাটে পানি দেখিয়ে জানান, তা ওয়াসার পানি।

১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গবেষণা উপস্থাপন করে জানায়, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের, কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করেন। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়। ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলে টিআইবি। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

এরপর গত ২০ এপ্রিল, শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক ওয়াসার পানি নিয়ে সদ্য প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা ওয়াসার এমডি। ওই সময় তাকসিম এ খান বলেন, ‘এটি কোনো প্রফেশনাল গবেষণা নয়, এটি একটি একপেশে প্রতিবেদন। এটি তাদের মন গড়া।’

তিনি বলেন, ‘টিআইবির প্রচারণার ধরন, কৌশল ও অ্যাপ্রোচ দেখে এটা সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে, গবেষণার সুনির্দিষ্ট তিনটি উদ্দেশ্যের রেশ ধরে আরোপিত পারসেপশনভিত্তিক মনগড়া তথ্য দিয়ে ঢাকা ওয়াসাকে জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল মূল লক্ষ্য।’

টিআইবিকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘পানির সংযোগ এবং গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য অনলাইনে আবেদনের কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। মিটার রিডার যাতে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ না করতে পারে, সে জন্য ইতোমধ্যে মিটার অটোমেশন পাইলটিং সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। অচিরেই ঢাকা ওয়াসার পানির মিটারকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে।’

অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির বিষয়ে টিআইবির অভিযোগ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তাকসিম এ খান বলেন, ‘অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা অত্যাধুনিক ওয়াসা লিংক ১৬ হাজার ১৬২ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেখানে গ্রাহকের দায়ের করা প্রতিটি অভিযোগ কণ্ঠ রেকর্ড করা হয়।’

‘জুলাই ২০১৮ থেকে মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত ১১ হাজার ৩৬৭ অভিযোগ পাওয়ার বিপরীতে ১১ হাজার ২০৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। নিষ্পত্তির সংখ্যাই বলে দেয় এখানে অনিয়ম, হয়রানি, দুর্নীতি, ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।’

‘ঢাকা ওয়াসার নিম্নমানের পানির কারণে প্রতি বছর পানি ফোটানোতে অপচয় ৩৩২ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসাকে নিয়ে টিআইবি যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, তা কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য না, এটি সম্পূর্ণ হাইপোথেটিক্যাল এবং বাস্তব বিবর্জিত।’

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর