খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে প্রার্থীরা পুরোদমে ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছেন। তবে বিএনপির মতো বড় দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে অন্য প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ ভোটাররা। ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় পার্টি প্রার্থী দুজনেই দাবি করেছেন, তাঁরা ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন। কারণ, বিএনপির সমর্থকেরা তাঁদেরই ভোট দেবেন।

আগের নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খুলনা সিটিতে বিএনপির একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। গত পাঁচটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী তিনবার, আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুইবার মেয়র হয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তালুকদার খালেক বিএনপির প্রার্থীকে ৬৭ হাজার ৯৪৬ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে তালুকদার খালেক বিএনপির কাছে ৬০ হাজার ৬৭১ ভোটে হেরে যান।

এবার বিএনপি নির্বাচনে নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুজ্জাম্মিল হক ১৪ হাজার ৩৬৩ ভোট পান। জাতীয় পার্টির এস এম মুশফিকুর রহমান পেয়েছিলেন ১ হাজার ৭২ ভোট। এবার ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় পার্টি প্রার্থী পরিবর্তন করেছে।

‘যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, সেই নির্বাচন নিয়ে দলের কোনো আগ্রহ নেই। ভোটারদের আগ্রহ নেই বলেও আমার বিশ্বাস। ধানের শীষের ভোটার অন্য প্রতীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে, এটা প্রত্যাশা করাও ঠিক না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন, খুলনায় মেয়র পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন টানা ১৯ বছর। তিনি চার বারের সংসদ সদস্য, একবার প্রতিমন্ত্রী এবং দুবার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর স্ত্রী হাবিবুন নাহার উপমন্ত্রী।

খুলনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো বিভেদ নেই। দলের পাশাপাশি ১৪ দলের নেতা-কর্মীরাও প্রচারণায় রয়েছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন খালেকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে রয়েছে। গত মেয়াদে তালুকদার খালেক অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করেছেন, যদিও উন্নয়ন ভোগান্তি নিয়ে ভোটারদের অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখন আওয়ামী লীগ থেকে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়ে নেতা-কর্মীদের জোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

গত দুই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে যারা এবারের ভোটের মাঠে রয়েছে, তার মধ্যে আওয়ামী লীগের পর ভোটার বেশি রয়েছে ইসলামী আন্দোলনের। গত নির্বাচনে তাঁরা তৃতীয় হলেও এবার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে চায়। প্রতিটি ওয়ার্ডেই দলের সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী রয়েছে। প্রার্থী না দেওয়ায় বিএনপির ভোট ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে আসবে বলে মনে করেন দলের নেতারা। বিএনপির পাশাপাশি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী অন্যান্য দলের ভোট হাতপাখার বাক্সে যাবে বলে বিশ্বাস তাঁদের।

জাকের পার্টি থেকে মেয়র পদে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। খুলনায় দলটির অবস্থা খুব একটা সুসংহত না হলেও হাতপাখার প্রার্থীর বাক্সে যেত, এ রকম কিছু সাধারণ ভোটারের ভোট কাটবে জাকের পার্টি।

জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। কর্মী-সমর্থকের সংখ্যাও কম। খুলনায় দলটির মধ্যে বিভেদ আছে। গত নির্বাচনে দলটির প্রার্থী মুশফিকুর এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর মনোনয়ন ফরম নিলেও বেগম রওশন এরশাদের নির্দেশনায় বসে গেছেন দলটির সাবেক সংসদ সদস্য গফ্ফার বিশ্বাস। তবে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন করবেন না বলে তিনি জানিয়েছেন।

২০১৮ সালের বিপর্যয় কাটাতে জাতীয় পার্টি থেকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে শফিকুল ইসলামকে। যদিও তিনি ২০১৩ সালে মেয়র পদে নির্বাচন করে মাত্র হাজার তিনেক ভোট পেয়েছিলেন।

তবে নিজেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দাবি করে শফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে নির্বাচনে তাঁর দোয়াত-কলম প্রতীক ছিল, এবার লাঙ্গল হওয়ায় তিনি লড়াইয়ে থাকবেন। বিএনপি মাঠে না থাকায় বিএনপির সমর্থকেরা তাঁকে ভোট দেবেন বলে মনে করেন তিনি।

অন্য প্রার্থীর পক্ষে বিএনপির ভোট যাওয়ার বিষয়টি নাকচ করে খুলনা নগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, সেই নির্বাচন নিয়ে দলের কোনো আগ্রহ নেই। ভোটারদের আগ্রহ নেই বলেও আমার বিশ্বাস। ধানের শীষের ভোটার অন্য প্রতীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে, এটা প্রত্যাশা করাও ঠিক না।’

খুলনা বিএনপি দুটি ধারায় বিভক্ত। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়ায় আটজনকে আজীবন বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে দলের বর্তমান নেতৃত্ব। এই আটজনের মধ্যে একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে। বাকিদের মধ্যে দুজন বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে ছিলেন। অন্য চারজন বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে নেই। বাকিরা দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয়। সাধারণ ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে কাউন্সিলর পদে দাঁড়ানো বিএনপিপন্থীদের তিনজনের আগে কাউন্সিলর হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।

বিএনপির দুই ধারার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, পুরোনো কাউন্সিলররা তাঁদের কিছু সমর্থককে কেন্দ্রে নিতে পারলেও বিএনপির বেশির ভাগ কর্মী এবার ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।

বিএনপিপন্থী একজন কাউন্সিলর প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দল থেকে নির্দেশনা আছে বিএনপি কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ায়। তারপর আমাদের কর্মীদের কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে। কট্টর বিএনপিপন্থীরা কাউন্সিলর পদে আমাকে ভোট দিলেও হয়তো মেয়রে ভোট দেবেন না।’

পাঁচটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে জামায়াত নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের ভোটাররা ভোট দিলেও মেয়র পদে জামায়াতের ভোট একক কোনো প্রার্থী পাবেন না বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বার্তাবাজার/এম আই