নৃশংস ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে গুলি করে ফের হত্যা চেষ্টা করে বলে জানিয়েছেন সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী রমনা ভবন বনিক সমিতির সভাপতি ও সে সময়ের কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

তিনি বলেন, মঞ্চের পশ্চিম দিক দিক থেকে কালো মুখোশ পড়া কিছু ব্যক্তি সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোড়েন। কিন্তু সেসময় নিরাপত্তা সহকারীদের কারণে শেখ হাসিনা গুলির হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু ওই গুলির আঘাতে নিহত হন নিরাপত্তাকর্মী মাহবুব।

২১ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামীলীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনের জাহাঙ্গীর শপিং কমপ্লেক্সের মালিক কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকাল থেকেই অন্যান্য দিনের মতো আমি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছিলাম। সাংবাদিকরাও ছিলেন। বিকেলে সমাবেশ। অন্যদিন সমাবেশস্থল ও আশপাশের ভবনে পুলিশ পাহারা থাকে। আমাদের জিজ্ঞেসও করে কোনো সমস্যা আছে কি না। কিন্তু ঐদিন কোনো পুলিশ নেই। সন্দেহ আরো গভীর হয়, উদ্বেগ বাড়ে।

প্রশ্ন জাগে, সমাবেশকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা কী? হঠাৎ আমার নিউ আধুনিকা দোকানের এক কর্মচারী এসে জানাল পীর ইয়ামেনী মার্কেটে কিছু লোক রহস্যজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে। সুধাসদন থেকে খবর পেলাম নেত্রী রওনা দিচ্ছেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের প্রায় শ’খানেক নেতাকর্মী নিয়ে ওসমানী মিলনায়তন থেকে নেত্রীর গাড়ি স্কট করে সমাবেশে নিয়ে আসি।

কুমিল্লার মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জের জাহাঙ্গীর ভবনের নিজ অফিসে বসে রোববার ভয়াল একুশে আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজের দেখা সেদিনের বিবরণ এভাবেই এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সে সময়ের সাধারন সম্পাদক ও রমনা ভবন বনিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, সমাবেশ শেষে মিছিল হবে। নেত্রীকে নিয়ে সমাবেশে ঢুকতেই কাটা তারের বেড়া ছিল। নেত্রীর গাড়ি ঢোকার পর আমরা আর ভেতরে গেলাম না, কারণ সেখানে জায়গা ছিল না। আমরা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার মার্কেট আর পাটি অফিসের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাই সভা চলছে। আমি আমার মার্কেটের সামনেই দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছি। নেত্রীর বক্তৃতা শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ মঞ্চ ঘিরে শুরু হলো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ। সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। প্রথম ভেবেছিলাম নেত্রী বোধহয় নেই।

চারিদিকে মানুষের চিৎকার- আহাজারি, বাঁচাও..মাগো, বাবাগো..চিৎকার। এমন সময় দেখলাম নেত্রীর আরেক বিশেষ সহকারী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। তাকে দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, নাসিম, নেত্রীর অবস্থা কী? সে বলল, নেত্রী নিরাপদে বের হয়ে সুধাসদনের দিকে গেছেন।

তারপর আমার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীসহ আমার মার্কেটের কর্মচারীদের নিয়ে আহত প্রায় ৬০-৭০জনকে উদ্ধার করে আমার মার্কেটের ভেতরে নিয়ে কেচি গেট আটকে দিয়ে তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেই।

ঘণ্টা খানেক পর বের হয়েই দ্রুত আহতদের কিছু সংখ্যককে হাসপাতালে ভর্তি করাই এবং বাকীদেরকে তাদের স্বজনদের কাছে তুলে দেই।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফেনীতে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি খোঁজ নিচ্ছিলেন গুলিস্তানের কী খবর। কারণ তার নির্দেশেই এই হামলা করা হয়েছিল। কারণ ঘটনাগুলো ছিল পরিকল্পিত।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, মধ্যরাতে নেত্রী সুধাসদনে আমাদের ডেকে পরদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যেতে বললেন যদিও ওখানে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় আমি প্রত্যেহ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে রীতিমত যেতে হয়। সবকিছু সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেন। সেদিন ভোর ৫টায় পার্টি অফিসের সামনে আমার মার্কেটের ভেতর যেয়ে আধুনিকা দোকানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সকাল ৮টার দিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ভাইও এলেন। আমরা পার্টি অফিসে ঢুকতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।

আমি চিৎকার করে বললাম, আমাদের অফিসে আমরা যাব, কালকে তোমরা মারছ পাইকারিভাবে। আজকে অফিসে যাব, সেখানে যাইতে দিবা না? আমরা যাবই বাধা দিলে মেরেই ফেলব, তখন আমার সাথে আমার মার্কেটের কর্মচারীরা ও গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের প্রায় শতাধিক হকার্সও ছিলো ওরাও বাহিরে পুলিশের উপর চড়াও হলো। পরে ওয়াকিটকিতে কথা বলার পর আমাদের ভেতরে যেতে দিল। চারিদিকে ছোপ ছোপ রক্ত, তখনো শুকায়নি।

হাতের আঙ্গুল, নখ, কাঁচা গোস্ত, হাজার হাজার জুতা পরে আছে। লাল ব্যানার ছিঁড়ে লাঠিতে বেঁধে ট্রাকসহ পুরো এলাকা আমরাসহ হকার্সদের দিয়ে ঘিরে রাখলাম। গ্রেনেডের চিহ্নিত জায়গাগুলোতে লাল পতাকা টানিয়ে দিলাম। একজন আর্মি অফিসার আর বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এসে আমাদের দেখে বিরক্তবোধ করছিলেন। ওইদিন রাতেই (২২ আগস্ট) সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে সব আলামত ধুয়ে ফেলল। মঞ্চ হিসেবে বানানো ট্রাকটাও নিয়ে গেল। কোনো আলামত ওরা রাখল না।

বার্তা বাজার/জে আই