বিদেশ থেকে পাচার করে আনা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের অর্থ-সম্পদ জব্দ করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। গত মঙ্গলবার সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স (এসপিএফ) পরিচালিত এই অভিযানকে দেশটির ইতিহাসে মানি লন্ডারিংবিরোধী সবচেয়ে বড় অভিযানগুলোর একটি বলা হচ্ছে।

এই অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারীসহ ১০ জনকে। তাঁদের প্রায় সবাই বিদেশি। এ ছাড়া আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। আর আটজন সন্দেহভাজন পলাতক। তাঁদের নাম পুলিশের তালিকায় রাখা হয়েছে। এই ব্যক্তিরা ধনী এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। বিলাসী জীবন যাপন করতেন।

পুলিশ অর্থ, বিলাসবহুল গাড়ি, অলংকার, হাতব্যাগ, ঘড়ি, মদ, মুঠোফোন, কম্পিউটারসহ নানা জিনিস জব্দ করেছে।

মঙ্গলবার পুলিশ সিঙ্গাপুরের ট্যাংলিন, বুকিত তিমাহ, অরচার্ড রোড, সেন্তোসা, রিভার ভ্যালিসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানের পর গতকাল বুধবার রাতে ১ জন নারীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে একই রাতে।

এসপিএফ জানায়, তারা আগে থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ লেনদেনের তথ্য পেয়েছিল। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লেনদেনের সন্দেহভাজন জাল নথিও ছিল। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুরজুড়ে একযোগে অভিযানে নামেন এসপিএফের সদস্যরা।

গতকাল এক বিবৃতিতে এসপিএফ জানায়, ৪০০ জনের বেশি সদস্যের বড় একটি দল এই অভিযানে অংশ নেন। এতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাণিজ্যিবিষয়ক বিভাগ (সিএডি), দাঙ্গা পুলিশের বিশেষ বাহিনী, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা যুক্ত ছিলেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যেসব বিদেশির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে, তাঁরা নিজ দেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই সঙ্গে তাঁরা অনলাইন জুয়া খেলার সঙ্গেও জড়িত। সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদন (এসটিআর) হাতে পেয়ে বিশদ অনুসন্ধানের পরই পুলিশ তাঁদের শনাক্ত করেছে।

সিঙ্গাপুরের মনিটারি অথরিটি (এমএএস) গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছে, সন্দেহজনক তহবিল ও সম্পদ শনাক্তের বিষয়ে সংস্থাটি সিএডির সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। অবৈধ লেনদেন প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিঙ্গাপুরের পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের অভিযানে ৯৪টি জমি এবং ৫০টি গাড়ির নামে নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, মালিকেরা এসব জমি ও গাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না। এসব জমি ও গাড়ির মোট মূল্য ৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে।

অভিযানে ৩৫টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এসব অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি ডলারের বেশি অর্থ জমা রয়েছে। এ ছাড়া জব্দের তালিকায় রয়েছে অনলাইনে সম্পদ থাকার ১১টি নথি, ২টি সোনার বার, ২৫০টির বেশি দামি ব্যাগ ও ঘড়ি, ১২০টির বেশি মুঠোফোন ও কম্পিউটার, ২৭০টির বেশি দামি অলংকার।

পুলিশ জানিয়েছে, অভিযানে জব্দ করা অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি।

আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাইপ্রাসের একজন নাগরিক রয়েছেন। তাঁর বয়স ৪০ বছর। তিনি বুকিট টিমাহ এলাকার বিলাসবহুল একটি বাংলোয় বসবাস করতেন।

ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ২১ লাখ ডলারের অর্থ জব্দ করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে তাঁর ১৩টি সম্পত্তি ও ৫টি গাড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এসব সম্পত্তি ও গাড়ির মূল্য ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বেশি। তাঁর নামে থাকা চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে ৬৭ লাখ ডলার আছে। আরও জব্দ করা হয়েছে বেশ কিছু দামি অলংকার ও মদের বোতল।

সিএডির পরিচালক ডেভিড চেউ বলেন, সিঙ্গাপুর যাতে পাচার করা অর্থের গন্তব্য না হয়, সে জন্য এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শনাক্ত ও প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটগুলো একযোগে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, সিঙ্গাপুরকে অপরাধীদের বা তাঁদের পরিবারের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা এবং এখানকার ব্যাংকিং সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

ডেভিড চেউ আরও বলেন, ‘এসব অপরাধীদের উদ্দেশে আমাদের বার্তা স্পষ্ট, যদি আমরা আপনাকে শনাক্ত করতে পারি, অবশ্যই আপনাকে গ্রেপ্তার হতে হবে। যদি কোনো অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা জব্দ করা হবে। আমরা আমাদের আইন মেনেই এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাব।’

এমএএসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (আর্থিক তত্ত্বাবধান) হো হের্ন শিন বলেন, বিশ্বের অন্যতম একটি আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুর। তাই দেশটি আন্তর্জাতিক অর্থ পাচারের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই অভিযান ও মামলা প্রমাণ করে যে অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে সিঙ্গাপুরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সহায়তা করছে।

বার্তা বাজার/জে আই