চলতি বছরের আগামী চার মাসের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে বাংলাদেশকে- এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। কিন্তু প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর তথ্য-উপাত্ত থেকে শুরু করে বেশির ভাগ বিশ্লেষণই ভুল, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) বিবিসি বাংলা ‘আগামী চার মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে পারবে বাংলাদেশ?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে ডলার সংকট। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা বাংলাদেশের জন্য জটিল হয়ে উঠবে।

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়ে দেখা যায়, ঠিক কিসের ভিত্তিতে এবং কোন উৎস থেকে বিবিসি এই তথ্য পেয়েছে তা উল্লেখ নেই। অনেকটা মনগড়া পরিসংখ্যান দিয়ে তারা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশ বড় রকমের বিপদে আছে।

বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশকে চলতি বছর ঠিক কত কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে মোট ৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। সে হিসাবে চার মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধের যে চিত্র বিবিসি দেখিয়েছে তা একেবারে ভিত্তিহীন।

শুধু আগামী চার মাস না, আগামী অর্থবছরেও বাংলাদেশকে এত বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। ইআরডি সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশকে মোট বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে ৪ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় চাপ আসবে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে। সে বছরও বাংলাদেশকে বিবিসির উল্লেখিত এত বড় অঙ্কের ঋণ শোধ করতে হবে না। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে, যা বিগত এবং আগামী যেকোনো অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাহলে ঠিক কীসের ভিত্তিতে বিবিসি ১২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করলো সেটি অনেকের আছে সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঠিক কোন সূত্র থেকে বিবিসি এমন কথা লিখেছে তা তারা নিজেরাও পরিষ্কার করেনি। একটি প্রতিবেদনের সত্যতা প্রকাশ পায় তার সূত্রকে কেন্দ্র করে। সেখানে সূত্রবিহীন এমন প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। মূলত যাদের থেকে তারা বাংলাদেশ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সেটি ভুল মাধ্যম। তাই বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে এ ধরনের ভুল সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর এবং এসএন্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় নতুন করে ঋণ কতটা পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

তবে মুডিসের এই ঋণমান যে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ায় বড় রকমের প্রভাব ফেলবে না, সে কথা পরিষ্কার জানিয়েছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

চলতি বছরের মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন গভর্নর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের যে রেটিং কমিয়েছে তা অর্থনৈতিক ভিত্তিতে করা হয়নি। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ আছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের যে অর্থনীতি ছিল তখন মুডিসের রেটিং ছিল বি-৩। সেসময় বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। পরে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার হলেও মুডিস নিজেদের রেটিং পরিবর্তন করেনি। রিজার্ভ কমার সঙ্গে সঙ্গে মুডিস রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে পরিষ্কার যে মুডিসের রেটিং অর্থনৈতিক নয় এবং এটি বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

তবে আশ্চর্যের বিষয় বিবিসির এমন ভিত্তিহীন প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই না করেই বাংলাদেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ঋণ শোধের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতো অর্থনীতিবিদরা যখন আগপিছ বিবেচনা না করে বলছেন, বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে আছে। ঋণ পরিশোধ না করলে বড় বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। এছাড়া ঋণ পরিশোধের রিসিডিউল করা বাংলাদেশের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ।

উল্লেখ্য, এর আগেও নানা সংবাদমাধ্যমে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিদেশি মদদপুষ্ট সংস্থার অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশ নিয়ে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

বিশেষ করে পদ্মাসেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে উৎসাহ এবং প্রশংসার বদলে এক শ্রেণীর সুশীল সমাজ কুৎসা রটানোয় সর্বাধিক ব্যস্ত ছিল- যার প্রমাণ সে সময়কার নানা গণমাধ্যমে দেয়া তাদের সাক্ষাৎকার।

২০১২ সালের ১ জুলাই গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন বলেছিলেন, নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে; কিন্তু শেষ করতে পারবে না।

সিপিডির ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।

তবে যারা দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে এত সংশয় প্রকাশ করেছেন, দিনশেষে তাদের কোনো শঙ্কাই সত্যিতে প্রমাণিত হয়নি। পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে, সেখান থেকে আয় উঠে আসছে, দেশের বাজার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এবং দেশের অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রমও সমান তালে চলছে।

এর আগেও লবিস্টদের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং ভুল তথ্য ও শঙ্কা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে অনেক অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে যাচ্ছেতাই তথ্য দিয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের কাছে অভিযোগ আছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ চাইলে দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ খেয়াল খুশিমতো এটিকে ‘বেইল-আউট’ ঋণ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন। এর ভিত্তিতে বার্তাসংস্থা ব্লুমবার্গে ভুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে তারা এর সংশোধন করেন।

সেসময় প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে আইএমএফ থেকে সম্ভাব্য তহবিল পেতে পারে তার ওপর ভিত্তি করে ঋণ চাওয়া হচ্ছে। তবে অনেকে এটিকে বেইল-আউট বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। বাংলাদেশ এমন কোনো সংকটে নেই যে বেইল-আউট ঋণ নিতে হবে।

বেইল আউট ঋণের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো নাজেহাল দশা ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের কোনো সংকটের মুখোমুখি হয়নি বাংলাদেশ।

যেসব অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের নামে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন তাদের নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, যারা এসব কথা বলছেন, তারা আগেও বলেছেন। পদ্মাসেতু নিয়ে তারা প্রতিনিয়ত নিরাশার বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে তাদের কোনো কথাই সত্যি হয়নি। নিরাশাবাদী অর্থনীতিবিদদের কথা আমলে নেয়ার কিছু নেই।

এদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া কেন বারবার বাংলাদেশ নিয়ে ভুল সংবাদ প্রকাশ করছেন এ প্রশ্নের জবাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশিদ বলেন, কারা এসব কথা ছড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে দিয়ে কারা ভুলভাল সংবাদ প্রকাশ করছে সেটি কমবেশি সবার জানা। নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা ছড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তবে এটি বেশিদিন চলবে না। নির্বাচনের পর পর এরা সবাই একযোগে চুপ হয়ে যাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বার্তা বাজার/জে আই