টিকিট কাউন্টারের সামনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, প্ল্যাটফর্মের প্রবেশ পথে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন, প্ল্যাটফর্ম-ভর্তি যাত্রী– এসবই ছিল কমলাপুরের এতদিনকার পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু এবার আর সেসব দৃশ্যের দেখা মিলছে না। টিকিটবিহীন কোনো যাত্রী ঢুকতে পারছেন না স্টেশনে। কানউন্টার আর প্ল্যাটফর্ম সবটাজুড়ে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। ছেড়ে যাওয়া অনেক ট্রেনের আসন ফাঁকা, ছাদে নেই কোনো যাত্রী। সব মিলিয়ে ঈদযাত্রায় ঘরমুখী মানুষের কাছে এ যেন এক অচেনা কমলাপুর!

গত বছর পর্যন্ত ঈদযাত্রায় যেসব চিত্র দেখা গেছে, যেসব অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে এবার সেসবের কোনো চিহ্ন নেই কমলাপুরে। একেবারে খোলনলচে পাল্টে যাওয়ার মতো বদলে গেছে সবকিছু। মানুষের ঈদযাত্রা হচ্ছে দারুণ স্বস্তির ও নির্বিঘ্ন। স্টেশনে কোনো বাড়তি ঝামেলাই পোহাতে হচ্ছে না যাত্রীদের। এমন ‘অপরিকল্পনীয়’ পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রেলের যাত্রীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, টিকিটি কাউন্টারগুলোর সামনে ২০-৩০ জন মানুষের ভিড়। রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান প্রবেশ পথও খালি। প্ল্যাটফর্মে আছেন শুধুমাত্র টিকিটধারী যাত্রীরা। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে যাত্রীর নির্ধারিত আসনটিও আছে ফাঁকা। ট্রেনের ছাদ একেবারে খালি। রেল কর্মকর্তাদের কণ্ঠে নেই কোনো মানবিক সুর। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েকটি টিম পুরো রেল স্টেশন মনিটরিং করছেন। এছাড়া ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হলেও এখন পর্যন্ত কোনো শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেনি।

নিয়মিত এই স্টেশন ব্যবহার করে যেসব যাত্রী ট্রেনে চড়েন, তারা এসব দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। হঠাৎ কেমন করে বদলে গেল এই স্টেশন! যাত্রীরা বলছেন— এটি তো রেলওয়ে স্টেশন নয়, যেন বিমানবন্দর।

প্ল্যাটফর্মে প্রবেশে কঠোর চেকিং

যাত্রীর নিজস্ব ভ্রমণ নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এবার আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হয়েছে।

এ টিকিটধারী যাত্রীরা যেন নির্বিঘ্নে ট্রেনে চড়ে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঢাকা, বিমানবন্দর এবং জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনে। কারণ, এসব স্টেশন থেকে ঈদের সময় বিপুল সংখ্যক যাত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে ভ্রমণ করেন।

দেখা গেছে, ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে বাঁশের জিগজ্যাগ তৈরি করা হয়েছে। এখানে প্রথম দফায় যাত্রীর টিকিট ও এনআইডি মিলিয়ে দেখছেন ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনাররা (টিটিই)। জিগজ্যাগ থেকে বের হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় টিকিট কাউন্টারের সামনের অংশেও চেকিংয়ে আওতায় আসছেন যাত্রীরা। সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় দফায় প্ল্যাটফর্মে প্রবেশর প্রধান গেটেও চেকিং করা হচ্ছে। আর এসব চেকিংয়ের কাজে সহায়তা করছেন রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যরা।

বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়ে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের যাত্রী শওকত ইমাম বলেন, আজ স্টেশনে প্রবেশ করতে কোনো ঝামেলা পাইনি। অথচ গত বছরও স্টেশনের শুরু থেকে ট্রেন পর্যন্ত আসতে প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হত। আজ এসে দেখলাম একেবারে ফ্রি। ট্রেনের ভেতরে তেমন মানুষ নেই। আমার সিটগুলো আমি ফাঁকা পেয়েছি। কাউকে বলতে হয়নি এ সিটটি আমার, আপনি উঠে যান। মনে হচ্ছে যেন রেল স্টেশন নয়, বিমানবন্দরে এসেছি।

ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনের ছাদ, খালি সিট নিয়েই কমলাপুর ছাড়ছে ট্রেন

আগে যাত্রা শুরুর দিন থেকে রেল স্টেশন সব প্ল্যাটফর্ম ভর্তি মানুষ থাকত। কারণ সেই সময় কোনো টিকিট চেকিং করা হত না। ফলে বিনা টিকেটের যাত্রীরা অনায়াসে ট্রেনে উঠে পড়তেন। নির্ধারিত আসনের যাত্রী আসার আগেই তারা সেই আসনটি দখল করে ফেলতেন। ট্রেনের ভেতরে এমন গাদাগাদি হতো যে, নির্ধারিত যাত্রী তার আসন পর্যন্তই পৌঁছাতে পারতেন না। কিছু কিছু মানুষ তো ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়তেন।

কিন্তু এবার আর সেই চিত্র দেখা যায়নি। টিকেটবিহীন একজন মানুষকেও প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে যেসব টিকেটধারী যাত্রী কমলাপুর রেলস্টেশন ব্যবহার করে ট্রেনে উঠবেন, তারা ছাড়া প্ল্যাটফর্মে আর কেউ নেই। এতে প্ল্যাটফর্মে কোনো ধরনের ভিড় দেখা যায়নি। যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারছেন। কোন ধরনের ভিড় ছাড়াই পৌঁছাতে পারছেন ট্রেন পর্যন্ত।

শুধুমাত্র টিকিটধারী যাত্রী ছাড়া কেউ প্ল্যাটফর্মে না থাকায় ট্রেনের ছাদে উঠার মানুষ পাওয়া যায়নি। কারণ কেউ যেন টিকিট ছাড়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে না পারে এবং ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে সে জন্য আরএনবির সদস্যরা এবং রেলওয়ের কর্মকর্তারা প্রত্যেকটি ট্রেন ছাড়ার আগে পরিদর্শন করছেন।

এমন চিত্র দেখে জামালপুরগামী জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী মাহমুদুর রহমান বলেন, এবার শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়ায় কাউন্টারে যাওয়ার ঝামেলা ছাড়া টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছি। কঠোরভাবে টিকিট চেকিংয়ের মাধ্যমে আমাদের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করানো হয়েছে। এতে শুধুমাত্র আমরা যারা টিকেটধারী আছি, তারাই মনে হয় প্রবেশ করতে পেরেছি। কারণ যাদের টিকিটে গরমিল আছে তাদের ফেরত পাঠাতে দেখেছি।

তিনি আরও বলেন, আগে দেখতাম ট্রেনে কেউ আমার সিট দখল করে বসে আছে। অথবা আমার কোচে উঠলেও আসন পর্যন্ত যেতে বেগ পেতে হত। বর্তমান ব্যবস্থায় আমি খুবই সন্তুষ্ট। হয়তো ধীরে ধীরে রেলওয়ে আরও পরিবর্তন আনবে। এটি আরও আগে আনা উচিত ছিল। আমি চাইব শুধু উৎসবে নয়, এখন থেকে সবসময় যেন এমনই থাকে।

নেই ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়

গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু ট্রেন বিলম্বে ঢাকা স্টেশন ছেড়ে গেলেও শিডিউল বিপর্যয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। গত ১৬ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের দ্রুতগামী ‌সোনার বাংলা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ায় অনেকই ধারণা করেছিলেন হয়ত এ ঈদ যাত্রায় শিডিউল বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটবে। তবে তেমনটি ঘটেনি।

দুর্ঘটনার কারণে ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের যাত্রা বাতিল করা হয়েছিল। এছাড়া চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের ট্রেনগুলো এদিন ২ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছেড়ে গেছে। এছাড়া বাকি রুটের ট্রেনগুলো ৩০-৪৫ মিনিট বিলম্বে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে।

আজ চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের ট্রেনগুলোর বিলম্ব ২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে এক ঘণ্টা করা হয়েছে। এ দিন চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ৫৫ মিনিট বিলম্বে ৮টা ১০ মিনিটে ঢাকা স্টেশন ছেড়ে গেছে। এছাড়া ধূমকেতু এক্সপ্রেস ৪০ মিনিট বিলম্বে; সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ৬টা ২০ মিনিটে (সঠিক সময়ে); নীলফামারীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ২০ মিনিট বিলম্বে ৮টায়; কিশোরগঞ্জগামী এগারো সিন্ধুর প্রভাতী ৭টা ২০ মিনিটে এবং দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ১৫ মিনিট বিলম্বে ৭টা ৪৫ মিনিটে; চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী প্রায় দেড় ঘণ্টা বিলম্বে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার বলেন, ২-১টি ট্রেন ছাড়া বাকি সব ট্রেন সঠিক সময়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। ২০/৩০ মিনিটকে বিলম্বকে শিডিউল বিপর্যয় বলা যায় না। কারণ, নানা কারিগরি বিষয় আছে। চট্টগ্রাম রুটে দুর্ঘটনার কারণে গতকাল ২ ঘণ্টা বিলম্ব ছিল। সেটা কমে আজ এক ঘণ্টা হয়েছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আজকে আন্তঃনগর, লোকাল, মেইল ও কমিউটারসহ ৫৫টি ট্রেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে যাবে। এর মধ্যে বিশেষ ট্রেন আছে ৩টি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, আপনারা দেখছেন একাধিক স্তরে আমাদের রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিসি, টিটিইসহ সবাই দায়িত্ব পালন করছেন। স্টেশনে প্রবেশের শুরুতেই র‌্যাব, পুলিশ ও আরএনবির কন্ট্রোল রুম আছে। তারপরেই টিটিইরা টিকিট এবং এনআইডি চেক করছে। একাধিক স্তরের এ চেকিংয়ের ফলে আমরা বিনা টিকিটের যাত্রীদের প্রতিরোধ করতে পারছি। টিকিটধারী যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।

তিনি বলেন, এবার ছাদে যেন কেউ উঠতে না পারে সেজন্য রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই কঠোরভাবে কাজ করছে। তারা এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে আছে। যারা বিনা টিকিটের যাত্রী, তাদের গেটেই আটকে দেওয়া হচ্ছে।

রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি স্টেশনে মনিটরিং জোরদার আছে ‌জানিয়ে মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, আমাদের একাধিক মনিটরিং কমিটি কাজ করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের একাধিক ভিজিলেন্স টিম মনিটরিং করছে। ঈদ যাত্রা সফল করতে প্রত্যেকটা স্টেশনে আমাদের মনিটরিং জোরদার আছে।

ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক বলেন, মানুষ প্রতিনিয়ত শিখে এবং নতুন নতুন আইডিয়াগুলো কাজে লাগায়। এবার শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হয়েছে। স্মার্ট রেলওয়ে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে।