যেভাবে হানাদার মুক্ত হলো কুড়িগ্রাম (পর্ব-১)

কুড়িগ্রাম জেলাটি ব্রিটিশ সরকার শাসন আমলে ১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী এই ৮টি থানা নিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমার জন্ম হয়। পরে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৮৪ সালের ২৩ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর এই ৯টি উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলায় উন্নীত হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ জেলাটির রয়েছে নানান ইতিহাস ।

এ জেলাটিকে নিয়ে ৯ পর্বের প্রতিবেদন করেছেন আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সুজন মোহন্ত,আজ থাকছে প্রথম পর্ব –

আজ ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। দিবসটিকে ঘিরে নানান কর্মসূচি পালন করবে এ জেলার বিভিন্ন সংগঠন গুলো ।

১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে কুড়িগ্রামকে পাক-হানাদার মুক্ত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এ অঞ্চলে সেদিন উদিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ২৩০ দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্ত হয় উত্তরের জনপদ কুড়িগ্রাম।

এই দিনে মুক্তিবাহিনীর কে ওয়ান এফএফ কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বিকেল ৪টায় কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করেন। এরপর তারা নতুন শহরের ওভার হেড পানির ট্যাংকের ওপরে (বর্তমান সদর থানার উত্তরে অবস্থিত) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয় বিজয়বার্তা। সেদিন বিজয় মিছিলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মিলিত হয় জাতির সূর্য সন্তাদের সঙ্গে।

জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা। ১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছিল একটি মহকুমা। ১৯৭১ সালের ১০মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা চিলড্রেন পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চের কাল রাতের পর সংগ্রাম কমিটি ২৮ মার্চ গওহর পার্ক ময়দানে জনসভা করে বেসরকারি হাইকমান্ড গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ এপ্রিল থেকে তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী দালালদের সহযোগিতায় তিস্তা নদী পাড় হয়ে লালমানিরহাট দখল করে নেয়। এরপর পাক বাহিনী ৭ এপ্রিল এবং ১৪ এপ্রিল দু’বার কুড়িগ্রাম দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নেয়।

এরপর থেকে দেশ মাত্রিকাকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে জুলাই মাস থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে থাকে একের পর এক সফল অভিযান। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় পাকবাহিনী গণহত্যা চালায়। এদিন পাকবাহিনী পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৩৪জন নিরীহ মানুষকে দাগারকুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে হত্যা করে। ১৪ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে জেলার ভূরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী, ৩০ নভেম্বর সমগ্র উত্তর ধরলা এবং ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরসহ সমগ্র জেলা হানাদার মুক্ত করে। এদিন দুপুরে পাক সেনারা রেল পথে কুড়িগ্রাম ত্যাগ করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় কুড়িগ্রাম জেলার অর্ধেক অংশ ছিল ৬ নং সেক্টর এবং বাকী অংশ ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীনে। শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী থানা ছিল মুক্তাঞ্চল। সেখানেই চলত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে শহীদ হন ৯৯ জন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধা শাহবুদ্দিন আহমেদ জানান,‘১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়া যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি আমি যুদ্ধ করে আমার জন্মস্থান কুড়িগ্রামকে এই দিনে স্বাধীন করেছি এটাও আমাদের গর্ব। গোটা দেশ একদিনে স্বাধীন হয়নি, বিভিন্ন দিন বিভিন্ন অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়েছে-এই বীরত্বগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে এই বীরত্বগুলো জানানো এবং তাদের এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব, সেই জায়গাটা আমাদের তৈরি করতে হবে।’

দিনটি স্মরণ করে কুড়িগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের নেতৃত্বদানকারী কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার বলেন,‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ ও গণতন্ত্রের বিকাশসহ বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের সুফল ভোগ করুক এটাই এই দিনে আমার চাওয়া।’

বার্তা বাজার/ডব্লিও.এস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর