স্বাধীনতাবিরোধীর ছেলের দখলে ‘৭১ এর মুক্তির মঞ্চ’সহ কোটি টাকার সরকারি সম্পদ!

মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের ‘মুক্তির মঞ্চ’সহ কয়েক কোটি টাকার সরকারি সম্পদ দখলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বাধীনতা বিরোধীর ছেলের ওপর।

এ দখল বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে সুনামগঞ্জ তাহিরপুরের তরং গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রউফ তালুকদারের ছেলে শামীম আহমদ তালুকদারসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে।

এ নিয়ে শতাধিক বীরমুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষরিত লিখিত অভিযোগপত্র গত কয়েক বছর ধরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহকারি কমিশনার (ভূমি) বরাবর দেয়া হলেও অদৃশ্য কারণে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া মৌজার ১নং খতিয়ানভুক্ত এসএ ও আরএস দাগে ৭৬.৩৬ একর সরকারি জমি রয়েছে।

ওই মৌজার ওই দাগে খতিয়ানের থাকা প্রায় ১ একর জমি জুড়ে থাকা ৭১’র মুক্তির মঞ্চ, সমাবেশ স্থল, ছোট মাঠ, তিনটি ভবন, ভবনের ভেতর থাকা চেয়ার, টেবিল, আলমিরা, সোফা, টেলিভিশন, খেলাধুলার উপকরণ, ১২টি জোড়া ড্রাম, মুল্যবান লোহাজাত সামগ্রী, অর্ধশত ফলদ ও বনজ দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ, দুটি শৌচাগারসহ প্রায় ১ একর জমি দখলে নেন শামীম আহমদের নেতৃত্বে থাকা একদল ভুমিখেকো চক্র।

এরপর ২০১৫ সালে রাতের আঁধারে ব্যক্তি মালিকানাধীন নাম সবর্স্ব একটি কিন্ডারগার্টেনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয় ওই চক্রটি। পরবর্তীতে জনসমাগম ও প্রশাসনের দৃষ্টিতে দখলবাণিজ্য আড়াল করতে জন চলাচলের একমাত্র কাঁচা সড়কটিও লোহাজাত সামগ্রী দিয়ে বন্ধ করে দেয় তারা।

শুধু সরকারি কোটির টাকার জমি দখলই নয় ওই জমির ওপর থাকা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন(বিসিআইসি) এর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেডের ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি (পতিত) প্রকল্পের প্রায় ৩০ লাখ টাকা মুল্যের শ্রমিক কর্মচারী ক্লাব, শ্রমিক ইউনিয়ন ভবন, শ্রমিক কর্মচাী ক্যান্টিনসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আসবাবপত্রসহ দখলে নিয়েছেন শামীম গংরা।

অভিযোগ রয়েছে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন শামীম আহমদ তালুকদারের বাবা প্রয়াত আব্দুর রউফ তালুকদারের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি সে সময় পাক হানাদার বাহিনীদের সহায়তা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

আর এবার তার ছেলে শামীম আহমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল ‘মুক্তির মঞ্চ’সহ সরকারি সম্পদ দখলের অভিযোগ। মঙ্গলবার উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলকাছ উদ্দিন বললেন, মুক্তির মঞ্চ, সমাবেশস্থল, ছোট মাঠ, তিনটি ভবন টিনশেড বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ করে রেখে বাইরে কিন্ডারগার্টেনের সাইনবোর্ড ঝুলালেও মুলতঃ ভেতরে শামীম গংরা এসব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট বিভিন্ন সময়ে ভাড়া প্রদান করেন।

এছাড়া তারা স্থানটি গরু চড়ানোর মাঠ, মালবাহি লরি পিকআপ ভ্যান রাখাসহ নিজেদের ব্যক্তিগত অফিস হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন।

উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার (অব:) বীর মুক্তিযোদ্ধা ধন মিয়া জানান, প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের গুটি কয়েক নেতার তদবির বাণিজ্যের কারণে কয়েক কোটি টাকার মূল্যের দখলে থাকা সরকারি জমি ও ‘মুক্তির মঞ্চ’ উদ্ধারকাজ বারবার থেমে যাচ্ছে।

বিসিআইসির ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শামসুল আরেফিন সুইট, আবুল ফয়েজ মন্টু এবং সজিব আহমদে সজল জানান, এই জায়গাটিতে দেশ স্বাধীনের পর থেকেই ভাষা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস এবং ১৫ আগষ্টের শোক দিবস এবং প্রয়াত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাগণের শোক-স্মরণ সভা পালনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবস, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গণমিলন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক খেলাধুলা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়ে আসছিল। কিন্তু শামীম গংরা দখলে নেয়ার পর থেকে তা আর হচ্ছে না।

উপজেলার যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক জেলা কমান্ডার আলহাজ্ব মোজাহিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ৭১’র মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাহিরপুরের শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের নয়াবন্দ গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও চিহ্নিত এক রাজাকার ছিলেন তরং গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রউফ তালুকদারের ভগ্নিপতি।

সেই রাজাকার ভগ্নিপতির সঙ্গে আব্দুর রউফ সে সময় পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হিসাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। মঙ্গলবার শামীম আহমদ তালুকদার তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করলেও তিনটি ভবনসহ ৭৫ শতাংশ সরকারি জমি দখলে নেয়ার কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করলেও ওই জমি এখনো আমাদের বন্দোবস্থ দেয়া হয়নি। জেলা প্রশাসক কতৃক বন্দোবস্থ না দেওয়ার আগে কোন আইনে সরকারি জমি দখলে নিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জমিটি বন্দোবস্থ পেতে আশা করি খুব শীঘ্রই তা পেয়েও যাব।

তার বাবা প্রয়াত আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ছিলেন না দাবি করে বলেন, যে জায়গা দখলের অভিযোগ করা হয়েছে সে জায়গায় আপাতত কিন্ডারগার্টেন চালু করা হয়েছে। সেখানে মুক্তির মঞ্চ বা মুক্তিযুদ্ধের কোনো কিছুই ছিলনা।

তিনি আরো জানান, আমি এই কিন্ডারগার্টেন পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক স্বপন কুমার দাস এর সভাপতি ,সহসভাপতি হলেন কয়লা ব্যবসায়ী রিয়াজ উদ্দিন, যুগ্ন সম্পাদক কয়লা ব্যবসায়ী মাটিকাঁটার ডা. মাসুদ ও কোষাধ্যক্ষ হলেন অপর কয়লা ব্যবসায়ী শ্রীপুর ৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি লাকমার জসীম উদ্দিন।

মঙ্গলবার তাহিরপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) মো. মুনতাসির হাসান বলেন, আমরা ট্যাকেরঘাটে সরকারি জমিতে দখলে থাকা শামীমসহ সব দখলদারকেই নোটিশ প্রেরণ করেছি। পরবর্তীতে মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থাকায় উচ্ছেদ অভিযান কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।

মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন,আমি এ বিষয়ে ইতিপুর্বেই তাহিরপুরের সহকারি কমিশনার(ভূমি)কে দিক নির্দেশনা দিয়েছি। সেখান থেকে কোনো প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর